গর্বিত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে রংপুর কারমাইকেল কলেজ। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল এর ভিত্তি স্থাপন করেন। সে হিসাবে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ হলেও নানা জটিলতায় শতবর্ষপূর্তির উৎসব আটকে ছিল তিন বছর ধরে। অবশেষে আজ রোববার শুরু হচ্ছে উত্তরের অক্সফোর্ড খ্যাত প্রাচীনতম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষপূর্তির উৎসব।
বহুল প্রতীক্ষিত এই উৎসব বর্ণাঢ্য আয়োজনে সম্পন্ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে কলেজ প্রশাসন। বর্ণিল সাজে সেজেছে ক্যাম্পাস। দুই দিনব্যাপী আয়োজনের উদ্বোধনী দিনে আজ সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রয়েছে বর্ণিল আয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে আনন্দ শোভাযাত্রা, সম্মাননা প্রদান, আলোচনা, স্মৃতিচারণা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বিশেষ অতিথি থাকবেন বাণিজ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহেমদ, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসকসহ রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
উৎসবে স্বনামধন্য শিল্পীরা গান ও দলীয় নৃত্য পরিবেশন করবেন। সন্ধ্যায় মঞ্চে উঠবে ব্যান্ড দল জলের গান। সমাপনী দিন আগামীকাল সোমবার সকাল ১০টায় শুরু হবে বর্ধিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি দেশের বেতার ও টিভি তারকা শিল্পীরা নাচ ও গান পরিবেশন করবেন। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকবে প্রয়াত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ড দল এলআরবি।
৮০০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কারমাইকেল কলেজ। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামে সমৃদ্ধ এই কলেজের মূল ভবন ইন্দোস্যারাসেনিক আদলে নির্মিত স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি, ২১টি বিষয়ে সম্মান ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। শতবর্ষপূর্তির উৎসবে অংশ নেবেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
অবিভক্ত বাংলার যে কটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল তার মধ্যে কারমাইকেল কলেজ রয়েছে প্রথম সারিতে। ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলায় উচ্চশিক্ষার প্রসার ও প্রচারে অসামান্য খ্যাতির অধিকারী এই বিদ্যাপীঠ। তৎকালীন রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলসহ অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়ি, আসাম ও সংলগ্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। তৎকালীন রংপুরে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক প্রতিষ্ঠান থাকলেও কলেজ পর্যায়ে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল রংপুর সফরে এলে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেই এ অঞ্চলে একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়। তাঁর অভিমত অনুযায়ী ১৯১৩-১৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন রংপুর জেলা কালেক্টর জে এন গুপ্ত কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। তাতে সাড়া দিয়ে অর্থ প্রদান করেন শীর্ষস্থানীয় জমিদাররা। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন মূল ভবনের ঠিক মাঝের অন্নদা মোহন হলে কলেজ প্রতিষ্ঠায় অর্থ জমিদাতাদের নাম পাথরে খোদাই করে লেখা আছে। ২৮ জন দাতার মধ্যে প্রথম নামটিই হলো অন্নদা মোহন রায় চৌধুরী বাহাদুর। এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় আরও দান করেন কুন্তি, কাশিমবাজার, রাধাবল্লভ, ধর্মপুর, মন্থনা, তুষভাণ্ডার, মহীপুরের পাঙ্গা, কুড়িগ্রাম, খোলাহাটি, রসুলপুর অঞ্চলের জমিদার, জোতদারসহ বিত্তবান ও বিদ্যানুরাগীরা। জমি দান করার দিক দিয়ে এগিয়ে আছেন কুন্তির প্রসিদ্ধ জমিদার ও শিক্ষানুরাগী সুরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী। তাঁরা দুই ভাইয়ের পক্ষ থেকে প্রায় ৪৫০ বিঘা জমি দান করা হয়। এরপর ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ নভেম্বর গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল রংপুরে এসে কলেজের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই কলেজে আইএ ও বিএ ক্লাস খোলার অনুমতি দেয়। সে সময় থেকে প্রায় দুই বছরের জন্য কলেজটির পঠন-পাঠনের কাজ চলে রংপুরের বর্তমান জেলা পরিষদ ভবনে। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি কলেজের মূল ভবনের উদ্বোধন করা হয়।
চারদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে যেন গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্য কীর্তি কারমাইকেল কলেজের শ্বেতশুভ্র মূল ভবন। রংপুরের লালবাগ হাট থেকে একটি গেট পেরিয়ে চুন-সুরকি ও সিমেন্টের সড়ক চলে গেছে কলেজের মূল ভবনের দিকে। ক্যাম্পাসের দক্ষিণে রংপুর ক্যাডেট কলেজ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে কারমাইকেল কলেজের ভূমিতে। কলেজে ঢুকতেই হাতের বাঁ দিকে পড়বে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন। একটু এগিয়ে গেলে শিক্ষকদের ডরমিটরি, যা ‘হোয়াইট হাউস’ নামে পরিচিত। পাশেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কিউএ মেমোরিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয় (কলেজ প্রাইমারি স্কুল)। আরও সামনে এগোলে চৌরাস্তা বা জিরো পয়েন্ট।
এ ছাড়া রয়েছে একটি সুদৃশ্য মসজিদ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, দ্বিতল ছাত্রী বিশ্রামাগার, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন, ক্যান্টিন, শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল, শিক্ষক ডরমিটরি, সাব পোস্ট অফিস, অত্যাধুনিক অডিটরিয়াম (নির্মাণাধীন), একটি টালি ভবন (বিএনসিসি ও স্কাউট), ছাত্র বিশ্রামাগার, প্রশাসনিক ভবন, বিশাল তিনটি খেলার মাঠ। মূল ভবনের পূর্বে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মারক ভাস্কর্য, যা নতুন মাত্রা যোগ করেছে মূল ভবনের নান্দনিকতায়। দক্ষিণে শহীদ মিনার, তিনতলা বিজ্ঞান ভবন (সেকেন্ড বিল্ডিং), তিনতলা কলা ও বাণিজ্য ভবন (থার্ড বিল্ডিং), দ্বিতল রসায়ন ভবন, নানা ফুলে সুসজ্জিত একটি বাগান। রয়েছে প্রায় সত্তর হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। কলেজের মূল ভবনের ঠিক মাঝে রয়েছে আনন্দ মোহন হল। উত্তর-পশ্চিম কোণে উন্মুক্ত মঞ্চ, যা বাংলা মঞ্চ নামে পরিচিত। কলেজের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র এটি।
কারমাইকেল কলেজে পড়েছেন সাহিত্যিক ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেত্রী জাহানারা ইমাম, রাজনীতিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাংবাদিক-লেখক আনিসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি অঙ্গনে নামকরা আরও অনেকে।
শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপন কমিটির সদস্যসচিব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই অনুষ্ঠানের অপেক্ষায় আছে। আমরা পরিচ্ছন্ন একটি অনুষ্ঠান উপহার দিতে চাই। এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।’
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কারমাইকেল কলেজ নিজেই একটি ইতিহাস। এই কলেজের সুনাম ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশে। এখানে লেখাপড়া করে অনেক কৃতী শিক্ষার্থী দেশবরেণ্য হয়েছেন।’