কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধনে ‘ধীরে চলো’ নীতি

কামরান সিদ্দিকী |

শান্তিনগর আইডিয়াল স্কুল। এক দশক আগে চালু রাজধানীর এই শিশুশিক্ষালয়টি ২০১৪ সালে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক (ডিডি অফিস) বরাবর। তিন বছরে কেউ পরিদর্শনে আসেননি। পাশেই ‘সাউথইস্ট স্কুল’ নামে আরও একটি কিন্ডারগার্টেন গত বছর নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। স্কুলের অধ্যক্ষ শাহাদাত হোসেনের ভাষ্যমতে, তারাও অধিদপ্তরের কোনো সাড়াশব্দ পাননি।

সারাদেশে এ রকম নিবন্ধনহীন কিন্ডারগার্টেন প্রায় ৬৫ হাজার। নিবন্ধনের আবেদনের স্তূপ পড়ে আছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে। ফলে নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করতেও উৎসাহ পাচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের নীতি কী?

দেশে বহু ধরনের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলিত থাকার পটভূমিতে সরকার কিন্ডারগার্টেনগুলোকে শৃঙ্খলায় আনার পদক্ষেপ নেয় প্রকৃত প্রস্তাবে ২০১১ সালে নিবন্ধন নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে। ২০১২ সালে নীতিমালাটি এক দফা সংশোধন হয়। শিশুশিক্ষার এই পর্যায়ে সরকারের জানার বাইরে নানা ধরনের পাঠ্যপুস্তক, বই-খাতার অতিরিক্ত বোঝা, অত্যন্ত উচ্চহারে ছাত্রবেতন, নানা নামে মাশুল ও চাঁদা আদায়, শিক্ষার পরিবেশের জন্য প্রয়েজনীয় নূ্যনতম জায়গা, শ্রেণিকক্ষ ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ বহু বছর ধরে মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু নীতিমালার পর তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ‘ধীরে চলা’র নীতিতে আছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। তবে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা কাজের ধীরগতির জন্য জনবল সংকট, প্রশাসনিক জটিলতা, সমন্বয়হীনতা প্রভৃতি উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে অনুমোদন না নিয়েই গড়ে তোলা মাদ্রাসাগুলোকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারি অনুমতি নিতে তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১৬ জুলাই এ বিষয়ে একটি আদেশ জারি করা হয়। এর পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে লাগামহীনভাবে চলা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের নিবন্ধন প্রক্রিয়া।

নূ্যনতম অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও কিন্ডারগার্টেনগুলোর চাহিদা রয়েছে। কারণ এলাকার শিশুদের ভালো বিদ্যালয় প্রয়োজন এবং রাজধানীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার আরও বেশি নিম্নমান ও বেহাল দশা।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩১৮। তবে বাস্তবে সংখ্যা অনেক বেশি বলে জানা যায়। কিন্ডারগার্টেন সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যই হচ্ছে, দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন ও সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এক কোটির বেশি শিশু-কিশোর শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে। এ ছাড়াও সাত লক্ষাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের মহাসচিব রেজাউল হক জানান, সারাদেশে পাঠদানের অনুমতি ও প্রাথমিক নিবন্ধনের আওতায় এসেছে মাত্র ৬০০ প্রতিষ্ঠান। ডিডি অফিসগুলো থেকে পরিদর্শনের পর দেওয়া সহস্রাধিক বিদ্যালয়ের আবেদনপত্র প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে জমা পড়ে আছে। মূলত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাজের গড়িমসিতেই এ অবস্থা হয়েছে বলে কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ।

রেজাউল হক জানান, নিবন্ধন বিধিমালা অনুসারে আবেদনপত্র জমার ৬০ দিনের মধ্যে বিভাগীয় উপপরিচালক ওই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে প্রতিবেদনসহ কাগজপত্রাদি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাবেন। তবে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগে পরিদর্শন চলছে না বললেই চলে। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে না।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এইচ এম খালিদ ইফতেখার স্বীকার করেন যে, গত তিন বছরে ৬০০ আবেদন নিবন্ধনের যোগ্য বলে অনুমোদন দিয়ে বিভাগীয় উপপরিচালকদের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

এত কম কাজ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক ইন্দু ভূষণ দেব জানান, এ বিষয়ের এখতিয়ারসম্পন্ন মূল্যায়ন কমিটির বৈঠক নানা কারণে বসানো সম্ভব হয় না বা তারিখ দিয়েও পিছিয়ে যায় বলে আবেদনগুলোর নিষ্পত্তির গতি কম। তবে এগুলো দ্রুততর করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

নিবন্ধনে মন্থর গতি নিরসনের জন্য ২০১৫ সালের ২ আগস্ট প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এবং সচিব বরাবর কিন্ডারগার্টেনগুলোর পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। মন্ত্রী এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেছেন বলে জানা যায়।

এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে কোনো ফাইল সহজে নড়াচড়া করে না। দুর্নীতির ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, কারও সঙ্গে বনিবনা না হলে ফাইল থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাগজ গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে।

জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, নিবন্ধন দেওয়ার ব্যাপারে সরকার নীতিগতভাবে কিছুটা নিরুৎসাহিত করছে। তবে যেহেতু নিবন্ধনের একটি নীতিমালা আছে, সেজন্য প্রক্রিয়াটি এখনও অব্যাহত রাখা হয়েছে।

অধিদপ্তরের ধীরে চলো নীতির কারণে নিবন্ধন প্রক্রিয়া থেমে আছে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সঠিক নয়। গত বছরও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিন্ডারগার্টেনকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিদ্যালয়-১ অধিশাখা থেকে গত বছরের ১৬ আগস্ট জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) নিবন্ধন বিধিমালা ২০১১ ও সংশোধিত বিধিমালা ২০১২ উপেক্ষা করে নার্সারি/ প্রিপারেটরি/ প্রি-ক্যাডেট/ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, ছাত্রছাত্রী ভর্তি, ভর্তি ফি নির্ধারণ, প্রযুক্তি ব্যবহার এবং পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি অনুসৃত হচ্ছে না। অন্যদিকে পাঠ্য তালিকায় বইয়ের আধিক্যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অননুমোদিতভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যাচাইক্রমে করণীয় নির্ধারণপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের জন্য বিভাগীয় বা মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে টাক্সফোর্স গঠন করা হয়েছে।

জানা যায়, গত বছর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় দেশ কাঁপানো জঙ্গি হামলার পর বিভিন্ন ধরনের কিন্ডারগার্টেনে কী পড়ানো হচ্ছে প্রশ্ন তুলে মিডিয়ায় খবর ও মন্তব্য প্রকাশের কারণেই ওই প্রজ্ঞাপন ও টাস্কফোর্স হয়।

নিবন্ধন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত না করে কিন্ডারগার্টেনগুলোর লাগাম টেনে ধরতে সরকার এ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বলে আপত্তি তোলেন কিন্ডারগার্টেন মালিকরা। তাদের দাবি, শর্ত মেনে নিবন্ধন করলে স্বাভাবিকভাবে কিন্ডারগার্টেনগুলোর মান বৃদ্ধি পাবে ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হবে। যেখানে বিধিমালা অনুসারে নিবন্ধনই হয়নি, সেখানে বিধিমালার প্রয়োগ দেখতে যাওয়া অর্থহীন।

তবে ওই টাস্কফোর্সগুলোরও কোনো তৎপরতার খবর জানা যায় না।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিন্ডারগার্টেনসহ অন্যান্য বেসরকারি উদ্যোগের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ইতিবাচক। এরই মধ্যে অনেক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে নিবন্ধন নীতিমালা ও টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

নিবন্ধন প্রক্রিয়া ধীরগতির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে জনবল সংকট থাকতে পারে। বিভাগীয় পর্যায়ে একজন ডিডির পক্ষে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়া কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। টাস্কফোর্সের কাজ ধীর হলেও চলমান রয়েছে বলে তিনি জানান।

সরকার নিবন্ধন নিরুৎসাহিত করছে কি-না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে নিরুৎসাহিত করার প্রশ্নই আসে না। বরং বেসরকারি শিক্ষাকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তাদের ব্যাপারেই সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062580108642578