গত কয়েক বৎসর ধরিয়া কিশোর গ্যাং কালচার সমাজের জন্য অনেক বড়ো মাথাব্যথার কারণ হইয়া উঠিয়াছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগিতে পারে, ১৪ হইতে ১৮ বৎসর বয়সি কিশোরেরা কী করিয়া এতখানি উচ্ছৃঙ্খল এবং নৃশংস হইয়া উঠিতে পারে? ইহা সত্য যে, আধা-সামন্ততান্ত্রিক এই দেশে কিশোর অপরাধ আগেও ছিল, তবে বর্তমান সময়ের মতো এমন হিংস্রতা আগে খুব একটা দেখা যায় নাই। খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো অত্যন্ত হিংস্র নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ করিবার প্রবণতাও বাড়িয়াছে উদ্বেগজনক হারে। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়ের বাজার এলাকার ‘স্টার বন্ড’ নামের কিশোর গ্যাংয়ের ১৭ সদস্যকে গ্রেফতারের পর এক বৎসর করিয়া কারাদণ্ড দিয়াছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। দণ্ডপ্রাপ্ত ১৭ জনকেই গত রোববার প্রেরণ করা হয় গাজীপুরে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। রাজধানীর উত্তরাসহ সারা দেশেই নানারূপে কিশোর গ্যাং কালচার দেখা যায়। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, কিশোরেরা এক অর্থে সমাজের দর্পণের মতো। তাহাদের মতে, শিশু-কিশোরদের বয়সটা নরম মাটির মতো। তাহাদের যেইভাবে পরিবার ও সমাজ হইতে গড়িতে দেয়া হইবে, সেইভাবেই গড়িয়া উঠিবে। যেই সকল পরিবারের সন্তানরা কিশোর অপরাধের সহিত যুক্ত, অনুসন্ধানে দেখা যাইবে—বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐ কিশোরের বিপথগামিতার নেপথ্যে রহিয়াছে পরিবারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা। কোনো অভিভাবকই চাহেন না তাহাদের সন্তান বিপথগামী হউক। কিন্তু আমরা যেমন চাহি না ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশা বৃদ্ধি পাক অথচ আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অপরিচ্ছন্নতা ও অসচেতনতার জন্যই ভয়ংকর ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্ত ঘটে, তেমনি পরিবারের বিবিধ অনুশাসন ও উদাসীনতার কারণে বিপথগামী হইয়া পড়িতে পারে আদরের সন্তানটি। তাহা ছাড়া বড়োদের আচরণ ও অপরাধের ভাইরাসও ঢুকিয়া পড়ে কিশোর মনে। পিতার অবৈধ উপার্জন কিংবা নীতিবর্জিত কাণ্ডকারখানা সংক্রমিত হইতে পারে কিশোর সন্তানের ভিতরেও।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন হইতে জানা গিয়াছে, কিশোর গ্যাং কালচার কোথাও কোথাও এতটাই বিপজ্জনক হইয়া উঠিয়াছে যে, তাহারা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গেও যুক্ত হইয়া পড়িতেছে। ইহা ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিও কোথাও কোথাও তাহাদের নেপথ্যে কাজ করে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, কিশোর বয়সিদের সহজেই প্রভাবিত করা যায়। তাহাদের বোধবুদ্ধি বিকাশের এই সময়টাতে যদি ‘ক্ষমতা’ নামক বিপজ্জনক জাদুকরি শক্তি মাথায় ঢুকাইয়া দেয়া হয়, তাহা হইলে তাহারা সহিংসতাকেই বাছিয়া লয়।
যদিও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে এই গ্যাং কালচার তৈরি হইতে দেখা গিয়াছে। আইনের ভাষায় ইহাকে বলা হয়, জুভেনাইল সাবকালচার। মাতা-পিতার সঙ্গে কিশোর সন্তানের দূরত্ব তৈরি এবং খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমিয়া গেলে সন্তানের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়িবেই। সুতরাং অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণহীনতা, অর্থের সহজলভ্যতা, ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের অবাধ সুবিধাসহ সমাজের প্রতিটা স্তরে নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় এইভাবে চলিতে থাকিলে কিশোর গ্যাং কালচারের বৃদ্ধি রোধ করা যাইবে না। এইজন্য নজর দিতে হইবে সমস্যার গোড়ায়।