কিশোরগঞ্জে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নেই ১৩৬৫ প্রতিষ্ঠানে

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি |

কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদরাসা, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এক হাজার ৭৮২টি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ ৯৮ হাজার। শিক্ষা বিভাগের তথ্য মতে, এর মধ্যে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’ রয়েছে মাত্র ৪১৭টিতে, বাকি এক হাজার ৩৬৫টিতে নেই। ফলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না।

মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কী : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান উপকরণের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম ও স্পিকারের সমন্বিত শ্রেণিকক্ষই ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহার করে কঠিন, দুর্বোধ্য ও বিমূর্ত বিষয়গুলোকে ছবি, এনিমেশন ও ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করা যায়। এ ছাড়া গতানুগতিক শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমের বদলে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক এ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করে শ্রেণি কার্যক্রমকে আনন্দময় করে তোলা সম্ভব। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষকরা নিজেদের তৈরি করা ডিজিটাল কনটেন্ট দিয়ে কার্যকরভাবে শ্রেণিপাঠ পরিচালনা করতে পারেন।

কিশোরগঞ্জে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কারণ সম্পর্কে শিক্ষা পরিচালনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণিকক্ষের সংকট রয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সাধারণ ল্যাবগুলোও প্রায় অচল পড়ে আছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে মোবাইল ফোনের ফ্রিকোয়েন্সিরও প্রবল ঘাটতি রয়েছে। নেটওয়ার্ক সমস্যায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ড্যাশবোর্ডে সংযুক্ত যাচ্ছে না।   

কিশোরগঞ্জ সদরের নান্দলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাসমিয়া হুরে জান্নাত মাল্টিমিডিয়ায় শিক্ষাদানের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন চার বছর আগে। বিদ্যালয়টিতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ের ৩১৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণিকক্ষ রয়েছে মোটে চারটি। তিন শ্রেণিকক্ষবিশিষ্ট ও প্রায় পরিত্যক্ত পুরনো টিনশেড ঘরেই ঝুঁকি নিয়ে চলছে ক্লাস। (তবে বিদ্যালয়ে একটি করে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, স্ক্রিন ইত্যাদি অনেক আগেই সরবরাহ করা হয়েছে।) এসব কারণে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখাতে পারছেন না তাসমিয়া। চর্চার অভাবে এখন নিজেই সেসব ভুলতে বসেছেন! তিনি বলেন, ‘যেখানে বাচ্চাদের পড়ানোর জায়গা নেই, সেখানে মাল্টিমিডিয়া বা ডিজিটাল ক্লাসরুম হবে কোত্থেকে!’

সূত্র জানায়, ‘তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার’—এ স্লোগানকে উপজীব্য করে ২০১২ সালের ২০ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শিক্ষকদের দিয়ে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালের ২ জুন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করার ঘোষণা দেন।

নানা সীমাবদ্ধতায় কিশোরগঞ্জসহ হাওরের বিভিন্ন জেলায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যক্রম ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। শিক্ষাদান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সম্পর্কিতরা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, জেলা ও উপজেলা সদর বাদে এ অঞ্চলের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। হাওরের অবস্থাটা আরো করুণ। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকের এ ব্যাপারে অনাগ্রহ রয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলায় সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার বেশ কিছু পদ ফাঁকা। ফলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যক্রম যথাযথ তদারকি করা যাচ্ছে না। 

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ সূত্র জানায়, জেলার ১৩ উপজেলায় এক হাজার ৩২৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে পড়ছে প্রায় চার লাখ ৯৪ হাজার ৪২১ জন শিক্ষার্থী (ছেলে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৩১২ এবং মেয়ে দুই লাখ ৪৫ হাজার ১০৯)। মাত্র ৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম থাকলেও আইসিটি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন প্রায় ৯১৫ জন শিক্ষক।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের আওতায় আনতে হলে সব বিদ্যালয়ে প্রথমে বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এরপর সব শিক্ষককেই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।

উপজেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য মতে, বাজিতপুরে বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসার সংখ্যা ২৭টি। কোনো প্রতিষ্ঠানেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করা হয়নি। ১৪টি প্রতিষ্ঠানে সনাতনী ডিজিটাল ল্যাবও নেই। বাকি ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছয়টিতে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), পাঁচটিতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও একটিতে এইচএসআইপি ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি একটিতে নিজেরাই সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।

বাজিতপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহজাহান সিরাজ জানান, বিসিসি থেকে সরবরাহ করা ডেস্কটপ, ল্যাপটপ ও প্রজেক্টের নষ্ট হয়ে আছে। তবে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব থেকে দেওয়া সরঞ্জাম সচল রয়েছে। উপজেলার শতভাগ শিক্ষককে মাল্টিমিডিয়া প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম না থাকায় ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষাদান করা যাচ্ছে না।  

নিকলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কারার সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁর উপজেলায় বেশির ভাগ উচ্চ বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম আছে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তা কম। এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকট আছে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করেন, হাওরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং মোবাইল ফ্রিকোয়েন্সির অভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014150142669678