‘শিক্ষা আইন-২০২০’ এর খসড়াকোচিং ব্যবসায়ীদের কাছে নতিস্বীকার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে ব্যাপক ঘষামাজা, সংযোজন-বিয়োজন শেষে ফের চূড়ান্ত করা হয়েছে ‘শিক্ষা আইন-২০২০’ এর খসড়া। এতে নোট-গাইড বই নিষিদ্ধের বিধান রাখা হলেও ‘কোচিং বাণিজ্যকে বৈধতা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। মূলত নোট-গাইড বই ব্যবসায়ী ও কোচিং বাণিজ্যে জড়িত সিন্ডিকেটের অনৈতিক প্রভাবের কারণেই বার বার বহুল প্রত্যাশিত এই আইনটি বাধার মুখে পড়েছে। এই চক্র যেকোন মূল্যে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন থেকে নিজেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারাগুলো বাদ রাখতে চান; এতে আমলাদের একটি পক্ষ ও শিক্ষা প্রশাসনের একটি চক্রেরও সায় রয়েছে। রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক সংবাদ প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, এবারও প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ঠেকাতে তৎপর হয়েছে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ব্যবসায়ী ও কোচিং বাণিজ্যে জড়িত ব্যক্তিরা।  তারা নোট-গাইড বইয়ের বাণিজ্য ধরে রাখা ও কোচিং বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে শিক্ষা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। আইনের ওই ধারা ঠেকাতে সরকারের সঙ্গে জড়িত কিছু লোককে ‘লবিস্ট’ হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘নোট-গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত কেউই এখন পর্যন্ত আমার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। পারবেও না।’

খুব শীঘ্রই শিক্ষা আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উঠবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নোট-গাইড বন্ধ হওয়া উচিত। দেশের প্রায় সব স্তরের মানুষই নোট-গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে। এগুলোর বিরুদ্ধেতো ব্যবস্থা নিতেই হবে।’

‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’তেও শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষানীতিতে আইনের মাধ্যমে নোট-গাইড বই ও কোচিং সেন্টারসহ সব ধরনের শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধের কথা বলা হয়েছে। অথচ শিক্ষা আইনের সর্বশেষ খসড়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলোকে বৈধতা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের প্রায় সর্বস্তরের কর্মকর্তারাই নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ও কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানতে চান। শিক্ষা বাণিজ্য স্থায়ীভাবে রোধ করতে চান। তারা শিক্ষার্থীদের শতভাগ সৃজনশীল বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল করাতে চান।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রতিবছর সারাদেশে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক কথা সাহিত্যিক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘শিক্ষা আইনে যদি বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার বন্ধ না করে শুধু নোট-গাইড নিষিদ্ধ করা হয়, তবে তাতে কোন লাভ হবে না। কারণ কোচিংয়ের সঙ্গে নোট-গাইড বাণিজ্যের একটি যোগসূত্র রয়েছে। আর পড়াশোনার জন্য যদি বাণিজ্যিক কোচিংকেই উৎসাহিত করা হয় তবে স্কুলের কাজটা কী?’

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকার নোট-গাইড ব্যবস্থা বন্ধ করতে চায়। বর্তমান সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থায় নোট গাইডের প্রয়োজন নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক নোট-গাইড প্রকাশকের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেন, ছাত্র-ছাত্রীদের নোট-গাইড কিনতে বাধ্য করেন বলেও অভিযোগ করেন মন্ত্রী। এসব বন্ধে তিনি জেলা প্রশাসকদের আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান। মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় নিষিদ্ধ নোট-গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের সর্বশেষ খসড়া অনুযায়ী, নোট-গাইড বই বলতে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর আলোকে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর লেখা থাকে যে পুস্তকে, যা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা হয় তাকে বুঝানো হবে। আইন পাসের তিন মাস পর থেকে নোট-গাইড বই এবং কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনসংক্রান্ত বিধান বাস্তবায়ন হবে। কোন ধরনের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না- এমন বিধান প্রস্তাবিত আইনের ১৬ নম্বর ধারায় রাখা হয়েছে। এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ৩ বছর কারাদ- বা ৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দেয়া যাবে। কাউকে নোট-গাইড বই ক্রয় বা পাঠে বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে এবং এক্ষেত্রে অভিযুক্ত শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা কমিটির সংশ্লিষ্ট সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক এখতিয়ারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই শুনে আসছি, শিক্ষা আইন হচ্ছে, নোট-গাইড বই ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে। আসলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এদের টাকার প্রভাবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোন লেখাপড়া নেই। শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, শিক্ষকরাও এখন নিষিদ্ধ নোট-গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’

শিক্ষা আইনের সর্বশেষ খসড়া অনুযায়ী, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। এমনকি তারা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না।

খসড়া আইনে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়ে বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনা ও কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা যাবে। শর্তগুলো হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালীন সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে না। এ শর্ত লঙ্ঘন হলে উক্ত কোচিং সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আর কোচিং সেন্টারে কোন শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতে পারবে না।

জানা গেছে, বিগত সময়ে নোট-গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আতাঁত করে শিক্ষা প্রশাসনের একটি চক্র নানা টালবাহানা ও অজুহাত তৈরি করে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করেছেন। এতে বার বার খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন অংশীজনের কাছে যাতায়াত করছে। কিন্তু এবার শিক্ষামন্ত্রী ও সচিব নোট-গাইড বই বাণিজ্যের লাগাম টানতে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন।

গোঁজামিল দিয়ে খসড়া তৈরির কারণে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হলে ক্ষোভ প্রকাশ করে সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষা আইনের খসড়ায় ব্যাপক অসামঞ্জস্য, বৈপরিত্য ও বিদ্যমান বিভিন্ন আইনের সঙ্গে অসঙ্গতি থাকায় আবারও এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফেরত পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর ফলে গত সরকারের আমলে শিক্ষা আইন আলোর মুখ দেখেনি।

গত বছর শিক্ষা আইনের খসড়ার ২৪ ধারার বলা হয়েছিল, আইন জারির পর সব ধরনের কোচিং নিষিদ্ধ হবে। যে কোন প্রকার কোচিং সেন্টার পরিচালনা ও কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা শাস্তিযোগ্য হবে। শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের লিখিত সম্মতি নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। তবে সর্বশেষ খসড়ায় কোচিং সেন্টারের কার্যক্রমকে স্বীকৃতি দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’র আলোকেই ‘শিক্ষা আইন- ২০১১’ প্রণয়ন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১২ সালে শিক্ষা আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করা হয়। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য এই খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়ে সেটি ফেরত পাঠানো হয়। এরপরই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে পড়ে খসড়া আইনটি। পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসা, নোট-গাইড বই ব্যবসায়ী ও কোচিং ব্যবসায়ীরাও এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046999454498291