কোচিংয়ের সব দায় শিক্ষকের নয়

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

কখন থেকে কোচিং শব্দটি আমাদের শিক্ষার অনুসঙ্গ হয়ে ওঠেছে সেটি বলতে পারি না। যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম তখন খুব একটা কোচিং চোখে পড়েনি। যতদুর মনে পড়ে প্রাইমারি ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির দু' চারজন ভালো শিক্ষার্থীকে আলাদা করে পড়ানো হতো। সে জন্য শিক্ষকেরা টাকা পয়সা কোনোদিন নিয়েছেন বলে শুনিনি। পাবলিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলে সংশ্লিষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস আরম্ভ হবার আগে বা ছুটির পরে শিক্ষকরা কিছু অতিরিক্ত সময় পড়াতেন। বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে। অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্বপুর্ণ কিছু প্রশ্ন লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করে দিতেন। পরীক্ষার জন্য এ প্রশ্নগুলো ভালো করে পড়তাম। সে চিহ্নিত প্রশ্নগুলোকে 'সাজেশন' বলা হতো। এ রকম ক্লাসকে আমরা প্রাইভেট ক্লাস বলতাম। এসব ক্লাসে শিক্ষকগণ যে সাজেশন বানিয়ে দিতেন তা থেকে অনেক প্রশ্ন পরীক্ষায় কমন পড়তো। 'কোচিং সেন্টার' নামে শিক্ষাব্যবসার সূত্রপাত এর আরো পরে। মূলত জায়গায় জায়গায় কোচিং সেন্টার চালু হবার পর থেকে কোচিং বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটতে শুরু করে। এখন এটি শিক্ষায় বড় ব্যাধি। এ ব্যাধি দূর করা বড়ো মুশকিল হয়ে উঠেছে। ক্যানসারের ন্যায় শিক্ষায় এটি এখন আতঙ্ক। এটি দূর করতে না পারলে শিক্ষার বারোটা বাজতে দেরি নেই।

 

শিক্ষা কোনো বিশেষ পণ্য নয়। পণ্য-দ্রব্যের মতো এর ক্রয় বিক্রয় চলেনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের  দেশে সে কাজটিই হয়ে আসছে। এ অপকর্মটি যারা করে তারা সবাই কিন্তু শিক্ষক নন। শিক্ষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশ এর সাথে জড়িত বটে। সেটি অস্বীকার করিনা। কিন্তু কোচিং বাণিজ্যের জন্য আমাদের দেশে কেবল শিক্ষকদেরই দায়ী করা হয়। শিক্ষক নিজের প্রতিষ্ঠানের দশ পনের জন শিক্ষার্থীকে না হয় একটু অতিরিক্ত সময়ে আলাদা করে পড়িয়ে থাকেন। হয়তো বা দু' চারশ করে টাকাও নেন। জেএসসি, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার দু' চার মাস আগে দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদা করে কিছু সময় পড়ানো লাগে। এ বাবদ শিক্ষক কিছু টাকা নিয়ে থাকেন। ভালোভাবে জীবন চলে না বলে কেউ কেউ প্রাইভেট পড়ান বটে। কিন্তু শহরে বন্দরে অলিতে গলিতে যারা সাইনবোর্ড ও ব্যানার টাঙ্গিয়ে দিনে-রাতে কোচিং সেন্টার চালিয়ে লাখ লাখ টাকা অর্জন করে তাদের দোষ কেউ দেখে না। বিভিন্ন নামে স্কুল-কলেজ বানিয়ে শিক্ষাব্যবসা করে। কোনোমতে পাঠদানের একটা অনুমতি নিয়ে গলাকাটা ফি নেয়। কেউ কেউ আবার অনুমতিও নেয় না। অন্য কোনো স্কুল কলেজের নামে পাবলিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রশন করিয়ে নেয়। বছরে এদের কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য হয়। এদের কারণে শিক্ষা আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। তাদের উপর কারো খবরদারি নেই। সব দোষ কেবল শিক্ষকদের। ছোটবেলায় একটি প্রবাদ শিখেছিলাম। সেটি এই, যত দোষ নন্দ ঘোষ। শিক্ষকদের বেলায় হয়েছে তাই। নকল, প্রশ্নফাঁস, নোট-গাইড কিংবা কোচিংয়ের কথা আসতে অনেকে শিক্ষকদের দায়ী করে। শিক্ষকরা অতিশয় নিরীহ ও ভদ্র বলে এসব কথায় কান দেন না। এর প্রতিবাদ করেন না। কেউ কিছু বললে চ্যালেঞ্জ করা পছন্দ করেন না। আর তাই প্রকৃত অপরাধীরা শিক্ষকদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেরা পার পেয়ে যায়। নোট-গাইড, প্রশ্নফাঁস ও কোচিংয়ের বেলায়ও হয়েছে তাই।    শিক্ষকরা স্কুল কিংবা কলেজ টাইমের আগে বা পরে যেটি করেন সেটি মূলত প্রাইভেট টিউশনির পর্যায়ে পড়ে। আমার ধারণায় এর বেশি কিছু নয়। আর যারা কোচিং সেন্টারে ব্যাচ ব্যাচ পড়িয়ে লাখ লাখ টাকা কামায় তাদেরটা কোচিংব্যবসা। কোচিংব্যবসা তাদের কাছে খুব লাভজনক। তেমন একটা মূলধন লাগে না। নামদাম ফুটাতে পারলেই হয়। নামকরা কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে। সন্তানকে ভর্তি করার জন্য অভিভাবকরাও লাইন ধরেন। স্কুল কলেজে না গিয়েও সে সময়ে কোচিং সেন্টারে যায়। বাবা-মাও অনেক সময় সন্তান স্কুল-কলেজে গেল কি গেল না, সে খবর রাখার গরজ বোধ করেন না। কিন্তু কোচিং সেন্টারে নিয়মিত না গেলে খবর আছে।

এভাবে সারা দেশে শিক্ষা এখন কোচিং ব্যবসায়ীদের হাতের মুঠোয়। তাদের কেউ দোষ দেয় না। দোষ পড়ে শিক্ষকের উপর। কোচিং বন্ধের হুমকি-ধমকি শিক্ষদের দেয়া হয়। যারা প্রকৃত কোচিং ব্যবসায়ী তাদের কেউ কিছু বলে না। তাই কোচিং বন্ধ করি করি করে আজ এতটি বছর পরও কোচিং বন্ধ হয় না। আইন করেও কোচিং বন্ধ করা যায় না। কোচিং ব্যবসায়ীদের খুঁটির জোর অনেক বেশি। শিক্ষকদের তা নেই। তাই তাদের ভয় ভীতি দেখিয়ে কোচিং ব্যবসাটি এক চেটিয়া করে নেবার অপপ্রয়াস সব সময় লক্ষ্য করে থাকি। প্রাইভেট টিউশনি ছোটবেলায় এক আধটু দেখেছি। কলেজে পড়া অবস্থায় অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতো। বৃদ্ধ বাবা-মার হাতে পরিবার চালাবার জন্য কিছু টাকা তুলে দিতে পারতো। দুর্বল শিক্ষার্থীরা আলাদা প্রাইভেট টিউশনি পড়ে গণিত ও ইংরেজির মতো কঠিন বিষয়ে তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারতো। আজকালের মতো পাকা দালান ঘর বানিয়ে কিংবা ঘর ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে কোচিং করাতে দেখিনি। এখন শহরের অলিতে গলিতে নানা দোকান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টার ও তাদের সাইনবোর্ডগুলো যে কারো নজর কাড়ে। এর সাথে তাদের নানা অফারও থাকে। কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যানার ও পোস্টার দেখে মনে হয় সেন্টারগুলোতে বুঝি শিক্ষা মেপে মেপে কেজি দরে বিক্রি হয়!  সাধারণ মানুষের পর্যন্ত কোচিং সেন্টারের প্রতি অন্য আকর্ষণ। সন্তানকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাতে তারা এক রকম পাগল। কোচিং বন্ধ করবার জন্য সরকার এখন একান্ত তৎপর। কিন্তু কোচিং সেন্টার বন্ধের কোনো উদ্যোগ দেখি না। কোচিং সেন্টারগুলো আগে বন্ধ করা উচিত। দেশে এমন অনেক কোচিং সেন্টারের নাম জানি যেখানে বছরে কোটি কোটি টাকা ইনকাম হয়। সারা দেশ জুড়ে এদের নানা শাখা রয়েছে। এরা বেপরোয়া কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কোচিং সেন্টার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে সারা দেশে কোচিং ব্যবসা বন্ধ হতে বাধ্য হবে। শুধু শুধু শিক্ষকদের ধমকি-ধামকি দিলে কোচিং বন্ধ হবে না। কেননা, পুরো কোচিংয়ের নাটাই তো আর তাদের হাতে নয়।     

কোচিংব্যবসা ও মাদক ব্যবসাকে আমি আলাদা করে দেখি না। দু'টোই দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। উভয় ব্যবসায় মুনাফা প্রচুর। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার যেমন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, তেমনি কোচিংয়ের বিরুদ্ধে একই নীতি গ্রহণ করা উচিত। দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে এ দু'টো বিষয় নির্মূল করতে হবে। মাদকের ছোঁবলে তরুণ প্রজন্ম যেমন ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে ঠিক তেমনি কোচিংয়ের নষ্ট বাণিজ্যে আমাদের শিক্ষা একেবারে বিনাশ হবার পথ ধরেছে। এ দু'টো বিষয়কে আমাদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। তাহলেই আমরা জয়ী হবো।     কোচিং ও প্রশ্নফাঁস উভয়ই একে অন্যের হাত ধরাধরি করে চলে। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এ জন্য কেবল শিক্ষকদের দোষারোপ না করে এর প্রকৃত কারণ খুঁজতে হবে। আমাদের সিলেবাস ও কারিকুলাম আরেকটু সীমিত করা অপরিহার্য। বিষয় সংখ্যা ও বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত করা প্রয়োজন।বইয়ের বোঝা না কমালে কোচিং বন্ধ হবে না। এত বেশি বিষয় ও বিষয়বস্তু শ্রেণিকক্ষে পড়াবার সময় কোথায়? শ্রেণিতে একশ-দেড়শ’র উপরে শিক্ষার্থী। চল্লিশ কিংবা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পিরিয়ডে কী আর এমন পড়ানো যায়? এত এত বিষয় ও বিষয়বস্তুর সিলেবাস শ্রেণিকক্ষে সামাল দেয়া অসম্ভব। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার অভাবে সাধারণ ধারার শিক্ষায় কোচিং বাণিজ্যের যেমন অবাধ সুযোগ থাকে তেমনি শিক্ষা পরীক্ষা নির্ভর হবার কারণে প্রশ্নফাঁস নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষার এ দু'টো ক্ষত সারাবার জন্য প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতির আমূল সংস্কার সাধন করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো- কোচিংব্যবসা চিরতরে বন্ধ করতে হলে আগে সারা দেশের সবগুলো কোচিং সেন্টার একদম গালা সিল দিয়ে বন্ধ করে দেয়া দরকার। শিক্ষার সব পৃষ্ঠপোষকতা শিক্ষকদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাতের ব্যবধান হ্রাস করতে হবে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। শিক্ষকের সংখ্যা গাণিতিক হারেও বাড়ছে না। সর্বাগ্রে শিক্ষকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একমাত্র জাতীয়করণের মাধ্যমে সে কাজটি করা যেতে পারে। শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ ছাড়া অন্য কারো হাতে শিক্ষা নিরাপদ নয়। শিক্ষা ব্যবসায়ীদের কাছে তো কখনোই নয়।     

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030579566955566