কোলাকুলি না করার, ঘরে থাকার ব্যতিক্রমী ঈদ

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দুর্যোগকালের ঈদের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। যুদ্ধদিনের ঈদের কথা মেলে ’৭১-এর পৃষ্ঠায়। কিন্তু মহামারীকালের ঈদের অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। বিপন্ন-বিষণ্ন-বিষাদমাখা এক ঈদের সাক্ষী হলাম আমরা। করোনাকালের এই ঈদ আমাদেরকে জানিয়ে দিল, কখনো কখনো ঘরেই খুঁজে নিতে হয় ঈদের রং, তা যতই হোক বিপন্ন-বিষণ্ন-বিষাদমাখা।

এরকম ঈদ অবশ্য এবার শুধু বাংলাদেশের ঘরে ঘরে হাজির হয়নি, সারা পৃথিবীতে করোনাকালের ঈদ প্রকৃতপক্ষে ঘরে থাকার ঈদ হিসেবে জারি করেছে তার আবেদন-আবেগ ও বিশ্বাসের আধার। ঘরে থেকে, শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, যেভাবে যতটুকু পরিসরে ঈদ আনন্দ করা যায়, এবারের ঈদের আনন্দ ঠিক ততটুকুই, যেন নিক্তিতে মাপা, একচুল এদিক-ওদিক হবার নয়।

ঈদের আগের রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলে দিয়েছিলেন কেমন হবে করোনাকালের ঈদ। নিষেধাজ্ঞা ছিল খোলা মাঠে ঈদের জামাত করার। পাশাপাশি প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও যেন মনে রাখা হয় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার শর্তাবলী।

এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার প্রতি আরোপ করেছেন সবিশেষ গুরুত্ব।

এরকম একটা ঈদ নিয়ে হয়তো সবারই থাকতে পারে দুঃখ, বিশেষ করে ছোটদের থাকতে পারে নানা রকমের অভিযোগ, কষ্ট ও মন খারাপের সংগত কারণ। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আমরা যদি বেঁচে থাকি, করোনাকে করতে পারি পরাজিত, নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রিত, তাহলে সবই সম্ভব হবে উসুল করা। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এসব মেনে চলা ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কিছু নেই। ’৭১ সালের পর আমাদের জাতীয় জীবনে কখনোই হাজির হয়নি এরকম একটা নিরানন্দের ঈদ।

তারপরও আমরা তো ঘরে বসে সেমাই-পোলাও খেয়ে ঈদের দিনটা পার করার সুযোগ পেয়েছি। অথচ ’৭১ সালে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ছিল রণাঙ্গনে, শরণার্থী শিবিরে ছিল লাখ লাখ মানুষ। জীবনই যেখানে বিপণ্ন সেখানে ঈদের আনন্দ-উৎসব হাজির হওয়া তো কল্পনাতেও দুরূহ। তারপরও ঈদ আসে ঈদ যায়, যেমনটা এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে, যেমনটা এসেছে বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালের দুর্যোগ দুর্বিপাকের ঘোর অমানিশায়।

২০২০ সালের ২৫মে-র এরকম ঘরবন্দী একটা ঈদ নিয়ে যাদের মন খারাপ তাদের জন্য স্মরণ করা জরুরি ’৭০, ’৭১ সালের ঈদের কয়েকটি খণ্ডচিত্র।

০১.
১৯৭০ সালের ঈদ হয়েছিল ৩০ নভেম্বর। তার কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ঊপকূল এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়। ভোলা ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত সেই ঝড়ে মারা যায় পাঁচ লাখ মানুষ। যদিও মনে করা হয় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের এই ঘূর্ণিঝড়কে মনে করা হয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়।

এই অবস্থায় ঈদ হাজির হয় এই জনপদে। সেই ঈদের মোনাজাত জুড়ে ছিল ভোলার ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আহাজারি। কেননা মাত্র ১৭ দিনের ব্যবধানে মানুষ ভুলতে পারিনি কিছুই। আর উপকূলীয় অঞ্চলের বাস্তবতা ছিল অবর্ণনীয়, তখনও ওইসব অঞ্চলে বাতাসে ছিল লাশের গন্ধ। স্বজন হারানোর বেদনা, আশ্রয়শূন্যাবস্থা, খাবারের অনিশ্চয়তা, শরীর ঢাকার বস্ত্রহীনতা- সবই বিদ্যমান ছিল উপকূলের ঘরে ঘরে।

এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছিল রাষ্ট্রের সীমাহীন উদাসীনতা আর নির্মমতা। তবুও ঈদ এসেছিল উপকূলে, ঈদ এসেছিল আজকের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। সেদিনের সেই নিদারুণ বাস্তবতা বাঙালিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদের কেউ নয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভোলা ঘূর্ণিঝড়ে স্পষ্ট হয়ে গেল ওরা শুধু শাসন করতে চায়, বিপদে-আপদে পাশে নাই।

০২.
সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের স্মৃতিকথায় একাত্তরের ঈদের বর্ণনায় খণ্ডচিত্র এরকম-
... ঈদের দিন শনিবার। যুদ্ধকালে কোনো জামাত জায়েজ নয়। নামাজে যাইনি। কনিষ্ঠ পুত্র কায়েসকে সঙ্গে নিয়ে সকাল ৯টায় সিদ্দিক বাজারের উদ্দেশ্যে বেরোলাম। রিকশায় চড়ে দেখি, সড়ক জনমানবশূন্য। ... আসলে শহরের অর্ধেক লোক নামাজে যায়নি। বাকিরা মসজিদে বা পাড়ায় পড়েছে। বহু বাড়িতে সাধারণ ভাত-সালুন পাক হয়। বহু বাড়িতে সেমাই কেনা হয়নি। আমি নিজে ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জামাকাপড় ক্রয় করিনি।... আমার জীবনে এই প্রথম ঈদের জামাতে শরিক হইনি।

০৩.
‘গুলিবিদ্ধ একাত্তর’ গ্রন্থে হাশেম খান লিখেছেন, আজ ঈদ। উৎসবের দিন, আনন্দের দিন। কিন্তু কী আনন্দ করবো এবার আমরা? নতুন জামাকাপড় বা পোশাক কেনাকাটার আগ্রহ নেই! শিশু-কিশোরদের কোনো আবদার নেই। চাওয়া-পাওয়া নেই। বাড়িতে বাড়িতে কি পোলাও কোরমা ফিরনী রান্না হবে? আমার বাড়িতে তো এসবের কোনো আয়োজন হয়নি। প্রতিটি বাঙালির বাড়িতে একইরকমই তো অবস্থা।

০৪.
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ২০ নভেম্বর, শনিবার ১৯৭১। আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামা কাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালা পর্দা কাঁচা হয়নি। ঘরের ঝুল ঝাড় হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি।

০৫.
২০ নভেম্বর ১৯৭১ ঈদের দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। সেদিনের প্রচারিত একটা গানের কথা ছিল এরকম, চাঁদ তুমি ফিরে যাও ... /দেখো মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা/রূপসী আঁচল কোথায় রাখবো বলো? ঈদের চাঁদকে ফিরে যেতে বলার কারণ যে কত বেদনাবিধুর ও সকরুণ তা স্পষ্ট হয়েছে এই গানে।

উপর্যুক্ত এই খণ্ডচিত্র যুদ্ধদিনের ঈদের বাস্তবতা দলিল। একাত্তরের সেই ঈদকে আমরা সেদিন ওইভাবে গ্রহণ করেছিলাম বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিয়েছে। পরের ঈদই পালিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মাটিতে। সুতরাং, আমাদেরকেও বিশ্বাস রাখতে হবে প্রতিবারই এরকম বিপন্ন-বিষণ্ন বিষাদমাখা ঈদ আসবে না। প্যানডেমিকের ধর্ম শত বছরে একবার আসা। সুতরাং, এই ঈদে ঘরে থাকি, নিজে বাঁচি, পরিবারকে বাঁচাই, দেশ বাঁচাই।

করোনাকালের কতিপয় ঘটনা আমাদেরকে ব্যথিত করেছে, আহত করেছে। করোনায় আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কি কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হচ্ছি? সারা বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণের চিত্র উদ্বেগের বৈকি। ঈদ নিয়ে আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন যতটুকু করা দরকার ততটুকু করতে পারছি না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে তাতে মনে হচ্ছে ‘আমাদেরকে করোনাকে সঙ্গে করেই চলতে হবে।’ তাই যদি হয় তাহলে তো করোনা নিয়ে গত আড়াই মাসের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণসাপেক্ষে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি।

ঘরে থাকার এই ঈদ নিয়ে কারোরই কোনো দুঃখ থাকবে না, যদি করোনা যুদ্ধে জয়ী হই আমরা। সকলের বিশ্বাস এই ঈদ ঈদ না, আরও ঈদ আছে। আরও ঈদ আমরা যেন ভালোভাবে করতে পারি, আমাদের জীবন-জীবিকা যেন স্বস্তির ও সুখের হয়, সেই নিশ্চয়তার বীজ বপন করা জরুরি।

একটা ঈদ নাইবা হলো জামায়াতের সঙ্গে, মসজিদেই না হয় হলো পড়া। সৌদি আরবে তো ঈদের আগে পরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। একটা ঈদে নাইবা হলো নতুন কাপড় পরা, নাইবা হলো খুব বেশি ভালো ভালো খাওয়া। একটা ঈদ বিপন্ন-বিষণ্ন বিষাদমাখা হয়েছে, হচ্ছে হোক। কিন্তু পরের ঈদ যেন ভাল হয়, পরের ঈদ যেন হয় অন্যরকম, সকলের মনের মতো।

ঈদের আগের দিনের পরিসংখ্যান বলছে, করোনায় সর্বোচ্চ ২৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ করোনা পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র-সর্বজনে। উপরতলার মানুষের দিকে তার ছোবল ডানা মেলছে, তাহলে পরিস্থিতি কি ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, সেই অবস্থা থেকে উত্তরণে আমরা কি যূথবদ্ধ হচ্ছি?

ঘরে থাকার ব্যতিক্রমী এই ঈদ নিয়ে কারোরই কোনো খেদ, দুঃখ-কষ্ট বেদনা থাকবে না যদি সম্ভব হয় ঘুরে দাঁড়ানো, যদি সম্ভব হয় ’৭১-এর মতো বিজয়ী হওয়া। করোনামুক্ত হোক বিশ্ব, করোনামুক্ত হোক দেশ, ঘুরে দাঁড়াক জীবন ও জীবিকা, মানবিক মানুষ হোক সকলেই- ঘরে থাকার ব্যতিক্রমী ঈদে, এই প্রত্যাশা রেখে সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057210922241211