ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্মারক ক্যাপিটাল প্রেস ও পাইওনিয়ার প্রেস নামের পুরান ঢাকার দুই ছাপাখানা। এগুলো থেকে ভাষা আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা ছাপা হয়েছে। ক্যাপিটাল প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল একুশের প্রথম লিফলেট। পাইওনিয়ার থেকে ছাপা হয়েছিল একুশের প্রথম বুলেটিন। ভাষা আন্দোলনের নানা কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কাজে ভাষাসংগ্রামীরা এ দুই প্রেসে এসে বৈঠকও করতেন। কালের বিবর্তনে কোনোমতে টিকে আছে বেগমবাজারের ক্যাপিটাল প্রেস। আর পাইওনিয়ার প্রেস পুরোপুরি উঠে গেছে।
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের একটু সামনে এগিয়ে যেতেই মৌলভীবাজারের বেগমবাজার। এর ৫০-৫১ নম্বর হোল্ডিংয়ে বর্তমানে ক্যাপিটাল প্রেসের অবস্থান। জংধরা দোকানের সাইনবোর্ডে প্রেসের নামটি পড়াও এখন কঠিন। ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ও সমর্থক এবং ক্যাপিটাল প্রেসের মালিক খলিল খান ও শফি খানের উত্তরসূরিরা আজও টিকিয়ে রেখেছেন প্রেসটিকে।
ক্যাপিটাল প্রেসের স্মৃতিচারণ করে ভাষাসংগ্রামী এ এম গোলাম মোস্তফা লিখেছেন, "১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দাঙ্গাবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে আমি আবারও গ্রেফতার হই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দেখতে পাই ভাষা আন্দোলন চূড়ান্তভাবে দানা বেঁধে উঠেছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশ দিয়ে মৌলভীবাজার প্রবেশের সাথে একটি প্রেস ছিল 'ক্যাপিটাল প্রিন্টিং প্রেস'। এখানে তখন কবি, লেখকদের আড্ডা হতো। ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধার ক্ষেত্রে এই প্রেসের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। আমি ছিলাম এই আড্ডার অন্যতম অংশীদার।"
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা নিহত হওয়ার পরপরই প্রথম লিফলেট তৈরি করেন কবি ও ভাষাসংগ্রামী হাসান হাফিজুর রহমান, যা ছাপা হয় পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ক্যাপিটাল প্রেস থেকে। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত 'একুশের সংকলন'-এ হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছেন, "গুলি চলার ঠিক পরের ঘটনা। আমি, আমীর আলী আর একজন আমার সঙ্গে ছিল, আমরা তিনজন মধুর ক্যান্টিনে ফিরে আসি এবং জেলখানার উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে চলে যাই।
সেখানে বসে একটা লিফলেট লিখি। এ সময় আমি স্বেচ্ছায় লিফলেট লেখার চেষ্টা করে প্রেসে যাই। সেখানে ঘণ্টা দু-তিনেকের মধ্যে প্রুফ দেখে লিফলেটটি ছাপিয়ে আনি। এর হেডলাইন ছিল 'মন্ত্রী মফিজউদ্দিন-এর আদেশে গুলি', লিফলেট ১/১৬ সাইজ ছিল। প্রেসটি সেদিন আমাদের সর্বাত্মক সাহায্য করেছিলো। চারটা সাড়ে চারটার দিকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। লিফলেট প্রায় দু'তিন হাজার ছিল। চকবাজার, নাজিরাবাজার ও বিভিন্ন দিকে লিফলেটগুলো ছড়িয়ে দেয়া হয়।'
ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ আরেক স্মারক পাইওনিয়ার প্রেস। যার অবস্থান ছিল পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর 'সওগাত' অফিসের বিপরীত গলিতে। বছর পাঁচেক আগে এ প্রেসটি ভেঙে ফেলা হয়। এ প্রেস থেকেই একুশের প্রথম বুলেটিন ছাপা হয়েছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি।
একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর কয়েকজন সংস্কৃতিকর্মী রাতের মধ্যেই একটি বুলেটিন প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও পলাশী ব্যারাক এলাকায় বিলি করেন। সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম, ফজলে লোহানী, হাসান হাফিজুর রহমান পাটুয়াটুলীর সওগাত অফিসের বিপরীত গলিতে অবস্থিত পাইওনিয়ার প্রেসে যান।
দুটি টেবিলে বসে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা ছাত্র হত্যার সংবাদের হেডলাইনের সংক্ষেপিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে ফেলেন। তাৎক্ষণিক একটি বুলেটিন তৈরি হয়ে যায়। বড় এক সিট কাগজে যত শিগগির সম্ভব রাতের মধ্যে ছেপে ফেলার ব্যবস্থা করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে আসেন। এ বুলেটিনের ভাষ্যে একটি মন্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়- 'বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব'।
একুশের প্রথম বুলেটিনের উদ্যোক্তা কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় লেখেন, 'একুশের প্রথম বুলেটিনটি ডাবল ক্রাউন কাগজে ছাপা হয়, পত্রিকার কাগজের মত বড় একটা পৃষ্ঠায় কয়েকটি লেখা ছিল। লেখাগুলো তৈরি করেন হাসান হাফিজুর রহমান ও মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম। আরও দু'একজনের ছোট করে কয়েকটা লেখা ছিল, তাদের নাম আজ মনে পড়ছে না। ছাপার সময় আমাদের সাথে ছিল আমীর আলী কিন্তু তার কোন লেখা ছাপা ছিল না।
আমি ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকেই লিফলেট তৈরি ও ছাপার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পাইওয়ানিয়ার প্রেসের মোহাইমেন সাহেব ও তার ছোট ভাই আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। প্রেসের ভেতরে একটি বড় টেবিল দিয়ে ও কাগজ দিয়ে আমাদের লেখার সুযোগ করে দেন। বুলেটিনটি ছাপার জন্য তারা আমাদের কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেননি। বিনা পয়সায় ছাপিয়ে দেন। প্রেসের কম্পোজিটর ও কর্মচারীরা অতি দ্রুত কম্পোজ ও ছাপার কাজ শেষ করেন। তাদের স্বতঃস্ম্ফূর্ত সহযোগিতার কারণে রাতের মধ্যেই বুলেটিনটি ছাপানো সম্ভব হয়েছিল। প্রেসের কর্মকর্তা প্রুফ ও কারেকশনের অনুরোধ করলে আমি বলি, এত কারেকশন লাগবে না। তাড়াতাড়ি ছাপান। বুলেটিনটি বড় কাগজের এক পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল।
এ দুই প্রেসের পাশাপাশি পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় অবস্থিত জুবিলী প্রেসটিও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। এ প্রেস থেকে ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতাকারী পত্রিকা 'মর্নিং নিউজ' ছাপা হতো। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন 'মর্নিং নিউজ' ভাষা আন্দোলনকে 'ভারতীয় ও হিন্দুদের আন্দোলন' হিসেবে আখ্যা দেয়। গায়েবানা জানাজা শেষে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল শেষে আন্দোলনকারীরা জুবিলী প্রেস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
সূত্র: সমকাল