ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী |

বাংলাদেশে বিজ্ঞান বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উন্নত প্রযুক্তি, বড় বড় আবিস্কার আর মানুষের সুখভোগের নানাবিধ পণ্য। অর্থাৎ বিজ্ঞান মানে প্রযুক্তি। এটাই প্রধান ধারা। আদতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি মোটেও প্রযুক্তিগত কোনো ব্যাপার নয়, এটা মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক। যেহেতু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই সংস্কৃতির একটা অংশ, তাই একই সঙ্গে এটা ব্যক্তি ও সমষ্টিগতভাবে অর্জিত সম্পত্তি। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক ভিত্তি। এমনকি যদি ওই ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো কাঠামো পিরামিড সদৃশও হয়। অবস্থাভেদে বিজ্ঞান নিয়ে কখনও উচ্চকিত আবার স্তিমিত আলোচনা হলেও এগুলো প্রায়শ বৈজ্ঞানিক নয়। বাংলাদেশে সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান শত্রু হচ্ছে দুই সুপরিচিত সখা- পুঁজিতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র। এরা হাত ধরাধরি করে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে তৎপর। 

বিজ্ঞান ও পুঁজিবাদের মধ্যে অদ্ভুত এক ভালোবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক বিদ্যমান। বিজ্ঞান পুঁজিতন্ত্র বিকাশ ও প্রসারে সহযোগিতা করেছে। পুঁজিতন্ত্র সমাজ বিকাশের ধারায় গড়ে ওঠে। তাই একে বিজ্ঞানের তৈরি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে বিজ্ঞানের অসংখ্য আবিস্কার ও উৎপন্ন দ্রব্য পুঁজিতন্ত্র লাভজনক কাজে ব্যবহার করে নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে। অন্যদিকে পুঁজিতন্ত্র যে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে, তা বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের অনুকূল। বিজ্ঞান ও পুঁজিতন্ত্র তাই যৌথভাবে মানুষের জন্য এক বিকশিত পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। কারিগর তার ছোট ওয়ার্কশপে কাজ করে এবং বিজ্ঞানী তার ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একে অপরের সহযোগিতায় সম্ভবত তাদের অজান্তেই শিল্প বিপ্লব সম্ভব করে তুলেছে। তবে একই সঙ্গে পুঁজিতন্ত্র বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সুফল মানব জাতির কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেও সচেষ্ট। কেননা, পুঁজিতন্ত্র বিজ্ঞানকে তার দাসে পরিণত করতে তৎপর। সে পণ্য চায়; কিন্তু পণ্য উৎপাদনে যে মনন ভূমিকা রেখেছে, তার বিকাশ চায় না। এভাবেই সে বিজ্ঞানের আবিস্কার বাজারের পণ্যে পরিণত করেছে। পুঁজিবাদ বস্তুবাদকে দর্শনগত দিকে না নিয়ে গিয়ে বরং নিছক স্থূল ভোগের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে ভোগবাদিতার অভিমুখে টেনে নিয়ে পুঁজিবাদ সমাজে বিচ্ছিন্নতার বিকাশ ঘটিয়েছে। যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি বা সামষ্টিকতা যা বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের প্রয়োজনীয় ভিত্তি গড়ে তুলে পুঁজিতন্ত্র বিজ্ঞানের বিকাশকে প্রতিহত করে। পুঁজিতন্ত্র বিজ্ঞানীকে চায় তার কর্মচারী হিসেবে; কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশকে সে ভয় করে। কেননা, বিজ্ঞান শোষণবিরোধী; কিন্তু পুঁজিতন্ত্র শোষণ ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। এ জন্য পুঁজিতন্ত্র শোষণ করার লক্ষ্যে শোষিত মানুষের ভেতর সামন্তবাদী মূল্যবোধকে গড়ে তুলে তা টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করে; এটা একটা প্রদীপ যার তলায় রয়েছে ঘোর অন্ধকার। বিজ্ঞান একটি বৈপ্লবিক শক্তি। এক সময় পুঁজিবাদও বৈপ্লবিক ছিল; তবে বর্তমানে নয়। আর তাই পুঁজিবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে যাচ্ছে, সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের বদলে বিজ্ঞানের সঙ্গে শত্রুতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করছে। দেশের উৎপাদিকা শক্তির মুক্তিতে ইতিবাচক ভূমিকা না রেখে এক অবরুদ্ধ সমাজ সৃষ্টি করে, যা পুঁজির পুঞ্জীভবন সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। বিকাশমান টেক্সটাইল, রেশম, লবণ ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। 

কৃষিকে ততটা উৎসাহিত করা হয়, যতটা অর্থকরী ফসল উৎপাদনে প্রয়োজন ছিল এবং শিল্প বিকাশে বাধা হয়- এই উভয়বিধ প্রয়োজনে। এটা সকলেরই জানা, সমুদ্র সভ্যতা বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছে, যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে অবদান রেখেছে; চলাচল ও ব্যাপকতার সামর্থ্য বিশেষত ব্যবসা-বাণিজ্যে। সমুদ্রের সাংস্কৃতিক অবদান প্রমাণ করে, সাগর আকাশ থেকে অনেক বেশি কার্যকর। আকাশ মূলত ব্যক্তির, সাগর সমষ্টির। বাংলার সমুদ্র রয়েছে; কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সমুদ্র বণিক ও জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই ভূমির দুই প্রান্ত পাহাড় ও পর্বত দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং অপর প্রান্ত অনুপ্রবেশকারীর দখলে। দখলকারীরা পশ্চিম দিক থেকে এসে দখল করে ভূমি এবং অধিবাসীকে করে বন্দি। সমুদ্র হারানোর ফলে মনের বন্দিদশা বাঙালি চিত্তকে করেছে সংকীর্ণ। আর তাই এটা লক্ষণীয়, বাঙালি মধ্যশ্রেণি যারা বাঙালি সংস্কৃতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালন করত, তারা সমুদ্রযাত্রা ও সমুদ্রের সম্পদকে অশুভ ধরে কুসংস্কার আরোপ করে। ইতিহাসে এর নজির রয়েছে। 

বাংলা রাষ্ট্রটা ছিল বাঙালিদের শত্রুপক্ষ। এ রাষ্ট্র বিজ্ঞানচর্চা বিকাশে বাধা হয়েছিল। এ জন্য রাষ্ট্র তার প্রজাদের কাছ থেকে আনুগত্য চেয়েছিল। ব্রিটিশ শাসক প্রজাদের আলোকিত করার ভান করত। অবশ্য এটা সত্য যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সত্যিই আলোকিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে প্রতিনিয়ত বাঙালি মানসকে সামন্ত মূল্যবোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। সর্বোপরি অর্থনীতির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে জনগণকে দরিদ্র করছিল। আর দরিদ্র মানুষের জিজ্ঞাসুপ্রবণ মনোভঙ্গি সৃষ্টি ব্যাহত করে। ব্রিটিশরা এ দেশে একটি মধ্যশ্রেণি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিল। এ জন্য তারা শিক্ষানীতিতে বাঙালিদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখে। এটা অনড় পশ্চাৎপদ প্রাচ্যশিক্ষা থেকে অনেক অগ্রসর ছিল। কিন্তু এটা ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষা। এই শিক্ষানীতি ব্যাপক গণমানুষকে শিক্ষিত করার পরিকল্পনা করেনি। বরং একটি নব্য শ্রেণি সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিল। দ্বিতীয়ত, এই শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দালাল সৃষ্টি করা; যথার্থ শিক্ষিত মানুষের মুক্তি নয়। আর এই দ্বিবিধ উদ্দেশ্যই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারপরও এই ইংরেজি শিক্ষাই কয়েকজন বড়মাপের মানুষ সৃষ্টি করেছিল। এদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি শুধু সংশয়বাদী ছিলেন না; নাস্তিকও ছিলেন বলে মনে করা হয়। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিজ্ঞানমুখী। কিন্তু এত বড়মাপের মানুষও সব শ্রেণির জন্য শিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তার লক্ষ্য ছিল ওপরতলার মানুষদের শিক্ষিত করা। ঊনবিংশ শতাব্দীর আরেক প্রথিতযশা পুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুরুতে নাস্তিক থাকলেও পরে আস্তিক হয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে তার শেষের দিককার লেখা ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের পক্ষে কাজ করেছে। তাদের এই ব্যর্থতা শ্রেণির; ব্যক্তির নয়। 

আসলে মধ্যশ্রেণিটি ছিল পরগাছা, যারা নাস্তিক্য চেতনা বিকাশে অযোগ্য। একই সঙ্গে এরা আসন্ন গণঅভ্যুত্থানের বিরোধী ছিল, যা তৎকালীন সমাজকে ভেঙে ফেলতে পারত এবং নতুন সমাজ অবশেষে মধ্যশ্রেণিরই হতো। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি বাংলায় সমাজ বিপ্লবের বিরুদ্ধে খোলাখুলি অবস্থান নেন। তার জাতীয়তাবাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে শত্রু হিসেবে ঠিকই চিনেছিল; কিন্তু এভাবে চিহ্নিত করতে ভয় পাচ্ছিল। দেখা গেল, এই জাতীয়তাবাদী মধ্যশ্রেণি যারা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের, তারা ক্ষমতাচ্যুত (অতীত) মুসলিম শাসকদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করল। এই সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্থ বিকাশের পক্ষে ছিল না। বাংলার মধ্যশ্রেণির দুটি শাখা- হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই ব্রাহ্মণ্যবাদী। ব্রাহ্মণরা আমলাতান্ত্রিক, তারা উৎপাদক নয়, ভোক্তা। সবচেয়ে মারাত্মক কথা- জ্ঞান অর্জন এ শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষক শ্রেণির কৃষির ওপর একটি স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল। কিন্তু তারা বহির্বিশ্বের অগ্রগতির তথ্য জানত না। তাই মধ্যশ্রেণির পক্ষে কৃষির বিকাশের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান অর্জন ও তার প্রয়োগ সম্ভব ছিল। কিন্তু তা তারা করেনি। শাসকদের সহযোগিতা তথা দালালি করে নিজেদের প্রসার ও বিস্তারে ব্যস্ত থাকাই ছিল তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা ছিল একান্তই লোভী এবং সমাজের নিচুস্তরের লোকদের থেকে যা পায়, তাই কেড়ে নিতে উদ্যত ছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যশ্রেণির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করে। এর পরিণাম বাংলার বিভাজন। 

অসাম্প্রদায়িকতা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একান্ত দরকার। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে সংস্কৃতিরও অসাম্প্রদায়িক হওয়াটা একেবারে গোড়ার ব্যাপার। বাংলার বৃহৎ জনগোষ্ঠী সব সময় অসাম্প্রদায়িক। মধ্যশ্রেণি তাদের সাম্প্রদায়িক এবং কোটারি স্বার্থের কারণে তাদেরকে অসাম্প্রদায়িক ও সমষ্টিগত স্বার্থবিরোধী করে তোলে। নির্যাতন ও ভয় দেখানোর পৃথিবীজোড়া মতাদর্শের বিরুদ্ধে অনেক আদর্শ মতাদর্শের উদাহরণ পৃথিবীতে বিরাজমান। যেমন বাংলার বাউল দর্শন। দর্শনগত দিক দিয়ে এরা অজ্ঞেয়বাদী এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবিমুখ। তারা সক্রেটিসের মতো দ্বান্দ্বিক এবং ন্যায়ের পক্ষে যুক্তিতর্ক করত। কিন্তু এই দুই সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা তাদেরকে স্ব-স্ব ধর্মভুক্ত করতে চেয়েছিল। সামন্ততন্ত্র সব সময় তাই চায়। ক'দিন আগে বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়া ঘেরাও করে পর্যটন স্থাপনা করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করল- পুঁজিবাদ কীভাবে মানবিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেয়। সামন্ততন্ত্র যা পারেনি, পুঁজিবাদ তা পারল। উপমহাদেশে প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে চার্বাকরা বস্তুবাদী ছিলেন। কিন্তু তাদের রচনা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উগ্রবাদীদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছে। বাংলায় উপকথা, ধাঁধা, প্রাচীন লোকগান প্রভৃতিতে অসাম্প্রদায়িকতার উপাদান বিদ্যমান। বাংলার ভেষজ ওষুধের ঐতিহ্য ছিল, যা টিকতে দেওয়া হয়নি। কৃষক, শ্রমিক ও নারীদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা আছে, যার বৈজ্ঞানিক মূল্য রয়েছে। প্রয়োজন এগুলোর পরিচর্যা করা। 

আমরা দুই শত্রুকে চিহ্নিত করেছি- সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র। এর সঙ্গে বাংলায় একটি শক্তিশালী ভাববাদী ঐতিহ্য রয়েছে, যা বিজ্ঞান ভাবনা বিকাশে সহায়ক ছিল না। উর্বর জমি এবং অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতার কারণে এখানে জীবনযাপন ছিল সহজ ও অনাড়ম্বর। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা জীবনযাত্রার মান বাড়ানোতে অনীহা আর একটি কারণ। তাই মানুষের জিজ্ঞাসা কম, সর্বোপরি একটি অদ্ভুত কিন্তু শক্তিশালী ধারণা বিরাজ করছে যে, আজ যেমন যাচ্ছে আগামীতেও তেমন যাবে। আসলে এসব লক্ষণ বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে, এর ভেতর সংশয়বাদের উপাদান খুব কম। ব্রিটিশদের তৈরি রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়। জাতীয়তাবাদীরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে। কিন্তু তারা সমভাবে সামন্তবিরোধী হতে পারেনি। অন্যদিকে জনগণের ভেতর নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রায় সবাই ধর্মকে ব্যবহার করত, অর্থনৈতিক ভাষায় কথা বলত না। এর একটি কারণ হলো, ধর্মের ভাষায় কথা বলা বেশি কার্যকর। অন্য কারণ হলো, এরা চাইত সাধারণ মানুষ সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তায় যেন সচেতন না হয়। বাংলাদেশে একটি পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে- এটাই সবার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে দেখা গেল, এ আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবায়িত হচ্ছে না। মূলত নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্রই এই ব্যর্থতার কারণ। 

রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ। দারিদ্র্য, আশ্রয়হীনতা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর নিত্যসাথী। আশা নেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। এ অবস্থায় এটা বিচিত্র নয় যে, মানুষ ধর্মের দিকে ঝুঁকবে, দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে আশ্রয় চাইবে। মৌলবাদের উত্থানও ঘটেছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও আর্থ-সামাজিক হতাশা থেকে। রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। সামন্ততন্ত্রকে দীর্ঘায়িত করে পুঁজিতন্ত্র বাঙালিকে মুক্ত করতে চেয়েছে (মানুষকে মুক্ত করার ইচ্ছা নেই পুঁজিতন্ত্রের এবং সামন্ততন্ত্র টিকিয়ে রাখে দারিদ্র্য ও দুঃখ-দুর্দশা)। দারিদ্র্য ও দুঃখ-দুর্দশার অন্ধকারে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করতে পারে না। বাংলাদেশে আজ সুস্পষ্ট তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এর কোনোটিই বিজ্ঞানমুখী নয়। ধনীরা পরিপূর্ণ ভোগবাদী, এখানে বিজ্ঞানের স্থান নেই। মধ্যবিত্তরা অস্থির এবং তাদের বিজ্ঞানচর্চার খুব একটা সময় নেই। দরিদ্ররা তার চতুর্দিকে শুধু অন্ধকারই দেখতে পায়। এ কারণে তারা তো বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনাচিন্তাই করতে পারে না। তাই চূড়ান্ত বিশ্নেষণে বলা যায়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ নির্ভর করে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে অভিগমন, তার অগ্রগতির ওপর। কেননা, প্রকৃত গণতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত থাকে। থাকে জিজ্ঞাসা করার স্বাধীনতা এবং নিজের মতামত অন্যকে জানানোর পরিবেশ। গণতন্ত্রের মর্ম হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়া। আর অন্য কিছুর আগে বিজ্ঞানের প্রয়োজন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র। 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029971599578857