খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ জন শিক্ষক। গতকাল মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে শিক্ষকরা এ নিয়ে অভিযোগ দেন।
অভিযোগপত্রে শিক্ষকরা উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জীবনানন্দ দাশ একাডেমিক ভবন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণ হিসেবে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বরের প্রতিবেদন তুলে ধরেন।
সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই ভবনের ছাদ সাড়ে ৫ ইঞ্চি হওয়ার কথা থাকলেও ছাদের পুরুত্ব ৩ থেকে সাড়ে ৪ ইঞ্চি। ফলে এক বছরের মধ্যেই ভবনের ছাদ, বিম, দেয়ালসহ অসংখ্য জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। তদন্ত কমিটির ভাষ্য অনুসারে, ছাদ নির্মাণে এমন দুর্নীতির কারণে সেই ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুর্নীতির কারণ হিসেবে তদন্ত কমিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অসততা ও অভ্যন্তরীণ প্রকৌশলীদের দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন এবং অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। কিন্তু তারপর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
শিক্ষকরা বলেন, নানা জায়গায় দৃশ্যমান ফাটলের কারণে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের প্রাণের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা শঙ্কিত। তদন্ত কমিটি এ ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় ঝুঁকির কথা উল্লেখ করলেও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের সতর্ক করেনি। এতদিনেও বিষয়টি সাধারণ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচারিত না হওয়াটা, এই দুর্নীতি ও তদন্ত গোপন করার চেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর পাঠ এই ভবনেই।
এছাড়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নির্মাণের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির চিত্র শিক্ষক সমাজ নজরে এনছেন। তাদের অভিযোগের মাধ্যমে জানা যায়, দুটি প্রতিষ্ঠানের হুবহু এক (১০.০০০%) হওয়ার পরও টেন্ডার কমিটি বিষয়টি আলোচনায় না এনে ক্যাসিনো সম্রাট জিকে শামীমের এর দরপত্র অনুমোদন করে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্থার পক্ষ থেকে দরপত্রের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের সভায় কমিটি দরপত্রটি বাতিল করে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ১৮ অক্টোবর সভায় আবারও জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠানেরই দরপত্র অনুমোদন করা হয়।
শিক্ষকরা বলেছেন, টিইসি কমিটির এ আচরণ বিস্ময়কর এবং সন্দেহজনক। টেন্ডার থেকেই যে দুর্নীতির সূচনা, সেই দুর্নীতির ভুক্তভোগী সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রায় এক বছর ধরে (১৯০ জন শিক্ষার্থী) লিখিতভাবে প্রভোস্ট বরাবর অভিযোগ দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ভবন নির্মাণে ২৩টি ত্রুটির কথা উল্লেখ করে ২৩টি সংস্কার প্রস্তাব করে এবং ভালোভাবে কাজ বুঝে পাওয়া সাপেক্ষে জামানতের অর্থ ছাড় করতে বলে। কিন্তু সমস্যা এখনও রয়ে গেলেও জামানতের বেশিরভাগ অর্থ ইতোমধ্যে ফেরত দেয়া হয়েছে।
এছাড়া অপরাজিতা হলের বৈদ্যুতিক কাজের আদেশপত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন ক্যাবলসের সামগ্রী ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে, এ হলের বৈদ্যুতিক কাজে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ইস্টার্ন ক্যাবলসের সামগ্রী ব্যবহার না করায় দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। ঠিকাদার বরাবর খুবির প্রধান প্রকৌশলীর পত্রতেই সেই প্রমাণ আছে।
প্রধান প্রকৌশলী তার পত্রে উল্লেখ করেন, অপরাজিতা ছাত্রী হলে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
অভিযোগকারী শিক্ষকরা নির্মাণ দুর্নীতি ছাড়াও খুবির বিভিন্ন ভবনের বৈদ্যুতিক কাজে বিপুল দুর্নীতির চিত্রও তুলে ধরেন। তারা বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সালাম ২০১৩ সালের ১০ জুলাই উপাচার্যকে পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছেন, কবি জীবনানন্দ দাশ একাডেমিক ভবনের বৈদ্যুতিক কাজে প্রায় ৪৩ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯৪ টাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের বৈদ্যুতিক কাজে প্রায় ৮৭ লাখ ৯২ হাজার ৩১০ এবং পাম্প হউজের বৈদ্যুতিক কাজে প্রায় দুই লাখ টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
এছাড়া দুদক বরাবর ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবরের চিঠিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের একই প্রকৌশলী জানিয়েছেন, জীবনানন্দ দাশ একাডেমিক ভবনের বৈদ্যুতিক কাজে আরও প্রায় ৬০ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন দুর্নীতির চিত্র দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) নজর এড়ায়নি। এ নিয়ে দুদক তদন্ত করছে। দুদকের ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিলের পত্র থেকে জানা যায়, তাদের তদন্ত তালিকায় রয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ফায়েকুজ্জামান, প্রধান প্রকৌশলী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান এবং অভ্যন্তরীণ ইঞ্জিনিয়ার মো. সাইফুল আলম বাদশা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস বলেন, শিক্ষকরা যে অভিযোগ করেছেন তা দুই বছর ধরেই ঘটছে। যে সব অনিয়ম আমাদের কাছে ধরা পড়ছে তা দ্রুত ঠিক করার জন্য উপাচার্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কার্যক্রমগুলো চলমান। তাছাড়া উপাচার্য বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকায় শিক্ষকদের অভিযোগের বিষয়ে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি এলে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, শিক্ষকরা দুর্নীতির বিষয়ে যে অভিযোগ করেছেন তার কোনো ভিত্তি নেই। অর্থ লেনদেন বা দুর্নীতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও জড়িত নয়। সবগুলো বিষয় নিয়ে দুদক তদন্ত করছে। সে কারণে শিক্ষকদের অভিযোগের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।