গবেষণায় চুরি, ঢাবি শিক্ষকের দায় স্বীকার

নিজস্ব প্রতিবেদক |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ নতুন নয়। প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠেছিল। এরমধ্যে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আবার, অভিযোগ সত্য নয় মর্মে কেউ কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে অজানা কারণে এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সোমবার (১৭ আগস্ট) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, মূলত, দ্রুত পদোন্নতির জন্য অনেকেই গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেন, যার সর্বশেষ সংযোজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু নাসের মুহাম্মদ সাইফ। ইতোমধ্যে তিনি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির কথা স্বীকার করেছেন। এদিকে, সাইফের জালিয়াতি করা ঠিক হয়নি উল্লেখ করে গবেষণা কমিটির মূল লেখক এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার ‘ঢাবি শিক্ষকের গবেষণার প্রায় সবই নকল’ শিরোনামে একটি অনলাইন পোর্টালে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে বাংলাভিশন রিসার্চ জার্নালের ১৭-২৬ পৃষ্ঠায় আবু নাসের মুহম্মদ সাইফের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘এডোপশন অব মোবাইল ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ : চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড প্রসপেক্টস’। এটি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব এমআইএস’- এর ১৮১-২০০ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কাশেম এবং আরও দু’জন গবেষকের ‘এম-ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ : কনজ্যুমার পারসেপশনস অ্যান্ড এক্সপেক্টেশন’ শিরোনামের গবেষণাপত্রটির হুবহু নকল (প্রায় ৯৯ শতাংশ)।

এই গবেষণার উল্লেখ করে আবু নাসের মুহম্মদ সাইফ প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এদিকে, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির কথা স্বীকার করেছেন সাইফ। তবে সাইফের ভাষ্য, আমি এটা প্রকাশ করতে চাইনি এবং এ গবেষণার কৃতিত্ব আমি কোথাও উল্লেখ করিনি। কিন্তু বাস্তবতা তার ঠিক উল্টো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তার জীবনবৃত্তান্ত ঘেঁটে তার কথার সত্যতা পাওয়া যায়নি। নিজের জীবনবৃত্তান্তের ‘প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহের তালিকা’ অংশের ৫ নম্বরে গবেষণার স্বত্ব স্বীকার করেন সাইফ।

প্রতিবেদন প্রকাশের পরের দিন আবু নাসের মুহম্মদ সাইফ ওই অনলাইন পোর্টালে একটি প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত পেপারের (গবেষণা) কাজ করেছিলাম। কাজের সমস্ত ড্রাফট, ফাইনাল কপি, প্রশ্নপত্র, এসপিএসএস ডাটা সেট সব আমার কাছে আছে। স্যারকে তখন ই-মেইলও করি। সমস্ত প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু আমাকে না জানিয়ে আমারই সম্পূর্ণ কাজ আমাকে ছাড়া প্রকাশ করা হয়। না জানার কারণে আমি ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি জার্নালে আমার সেই লেখা প্রকাশ করি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর বিষয়টি জানতে পারি, খুবই দুঃখ পাই, কষ্ট পাই। এরপরও এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড মেনে আমিই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে কখনও কোনো পদোন্নতিতে অথবা নিজের বেনিফিট কোনো বিষয়ে লেখা ব্যবহার করিনি।’

সাইফের এমন বক্তব্যের জবাবে গবেষণাকর্মের মূল লেখক আবুল কাশেম বলেন, আমি এ গবেষণাটি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে করেছিলাম। তার (সাইফ) সঙ্গে আমি কোনো কাজ করিনি কিংবা সেও আমার সঙ্গে কোনো কাজ করেনি।

সে কাজ করেছে বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক জহিরুদ্দিন মাহমুদ বাবরের সঙ্গে। তিনি বলেন, সে যে আমার গবেষণা নকল করেছে সেটা আমি কয়েকদিন আগে জেনেছি। খবর প্রকাশের পর সে ফোন দিয়ে আমার কাছে ভুল স্বীকার করেছে। আমি তাকে সবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এরপর তার সঙ্গে আমার কথা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আবু নাসের মুহাম্মদ সাইফ কাউকে না জানিয়ে এটা প্রকাশ করেছে। যখন এটা প্রকাশ পায়, তখন সুপারভাইজারের সঙ্গে তার কথা বলা উচিৎ ছিল।

এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কিনা জানতে চাইলে ঢাবির ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেন, জালিয়াতির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিবে। আমি আশা করি, সে যে কাজটা করেছে সেটা থেকে সরে আসবে এবং এ ঘটনার জন্য ভুল স্বীকার করবে।

ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সে যে বলছে গবেষণাটি কোথাও ব্যবহার করেনি এরমধ্য দিয়ে সে গবেষণা নকলের কথা স্বীকার করেছে। মূলত, গবেষণা কোথাও ব্যবহার করা না করা কোন ম্যাটার না। ম্যাটার হচ্ছে সে গবেষণা নকল করে প্রকাশ করেছে। এটাই তো অপরাধ।

এ বিষয়ে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন বলেন, ঘটনাটি আমরা শুনেছি। ফরমাল অভিযোগ পেলে ভালো হতো। তারপরও আমরা বিভাগের শিক্ষকরা এ বিষয়ে আলোচনা করছি। আলোচনা শেষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে তার বিভাগের চেয়ারম্যান ও ডিন আমাদের কাছে সব অভিযোগ জমা দিলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।

এদিকে, অনলাইন পোর্টালে ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে আবু নাসের মুহাম্মদ সাইফের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রভাষক নুশরাত জাফরিন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, ওই প্রতিবেদক তার স্বামী সাইফের কাছে প্রতিবেদন না করার বিনিময়ে টাকা চেয়েছে। সাইফ সেটা ফেসবুকে শেয়ারও করেছেন। এরপর এই স্ট্যাটাস নুশরাত মোট ১১ বার এডিট করেছেন। বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ১৮ মিনিটে পোস্ট এডিট করে তিনি ওই প্রতিবেদকের বিষয়টি মুছে ফেলেন। এরপর সেখানে লেখেন, নিউজ না করার জন্য অন্য গণমাধ্যমের সাংবাদিক তার স্বামীর কাছে টাকা চেয়েছে। সংবাদের কাছে তার তথ্যপ্রমাণ আছে। সাইফের মুঠোফোনে কল দিয়ে তার কাছে টাকা দাবির সত্যতা জানতে চাইলে সাইফ জানান, এ ধরনের স্ট্যাটাস দেয়া হয়নি।

সাংবাদিকের বিরুদ্ধে টাকা দাবির অভিযোগের সত্যতা জানতে গতকাল বিকেল থেকে বেশ কয়েকবার অভিযুক্ত শিক্ষক দম্পতির মুঠোফোনে কল দিয়েও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে, নুশরাত জাফরিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের প্রতিক্রিয়ায় ওই প্রতিবেদক বলেন, আমি যথেষ্ট প্রমাণসহ নিউজ করেছি। অভিযুক্ত ওই শিক্ষক আমার কাছে নকলের কথা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু সংবাদ প্রকাশের পর তার স্ত্রী নুশরাত জাফরিন ফেসবুকে তার নিজস্ব আইডিতে আমি তার (সাইফ) কাছে খবর প্রকাশ না করার জন্য টাকা চেয়েছি উল্লেখ করে একটি পোস্ট দিয়েছেন। এটা আমার জন্য মারাত্মক মানহানিকর বলে মনে করছি। আমি কারও কাছে টাকা দাবি করিনি। তিনি যেহেতু এটা দাবি করেছেন, তাকে এটার প্রমাণ দিতে হবে। যদি তিনি সেটা প্রমাণ করতে না পারেন, তবে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফেসবুক পোস্টের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যথায় আমি তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করতে বাধ্য হব।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005648136138916