গাইড, প্রাইভেট ও কোচিং বন্ধে প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ

মো. আবু হানিফ ভূইয়া |

প্রথম শ্রেণি থেকে ম্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত  শিক্ষার্থীদের গাইড, প্রাইভেট ও কোচিং-এর ওপর নির্ভরশীলতা শিক্ষার গুণগত মানকে নস্যাৎ করছে। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিতে পারলেও আমরা কী ভেবে দেখেছি, কেন শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতেই প্রাইভেট ও কোচিং-এ দৌড়ায় এবং কমপক্ষে  দুই সেট গাইড বই কিনতে বাধ্য হয়? পাঠ্যবই ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মধ্যে অসামঞ্জ্যতা ও সংখ্যাতিরিক্ত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিশাল সিলেবাস এবং বছরে শতকরা ৪০-৪৫ দিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে না হওয়া ইত্যাদি এ জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি। যেমনঃ (১) পঞ্চম শ্রেণির গণিত পাঠ্যবইয়ের পঞ্চম অধ্যায় (গুণিতক ও গুণনীয়ক)-এ ৩৭ পৃষ্ঠায় ৩ নং প্রশ্নটি হলো- “একটি রাস্তায় কিছু গাছ এবং ল্যাম্পপোস্ট আছে। ২৫ মিটার পর পর গাছ এবং ২০ মিটার পর পর ল্যাম্পপোস্ট আছে। রাস্তায় শুরুতে গাছ এবং ল্যাম্পপোস্ট একত্রে থাকলে কত মিটার পর পর গাছ এবং ল্যাম্পপোস্ট পুনরায় একসাথে থাকবে”। 

অথচ, পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা-২০১৭-এর গণিত প্রশ্নপত্রে দেয়া হলো-“ ফরহাদ তার বাগানের জন্য কিছু চারাগাছ ক্রয় করলো। সে যদি প্রতি সারিতে যথাক্রমে ১০, ১২ ও ১৫ টি চারা রোপণ করে তবে- (ক) কমপক্ষে কতটি চারা রোপণ করলে প্রতিক্ষেত্রে কোনো চারা অবশিষ্ট থাকবে না? (খ) যদি চারার সংখ্যা ৬৮ হতো তাহলে চারার সংখ্যা কত হতো? (গ) যদি প্রতিক্ষেত্রে ২ টি চারা অবশিষ্ট থাকতো তাহলে চারার সংখ্যা কত হতো”? অর্থাৎ, পাঠ্যবই-এর প্রশ্নে গতানুগতিক ধারায় একটি উত্তর, আর পরীক্ষার প্রশ্নে সৃজনশীল ধারায় ৩ টি উত্তর বের করতে হয়। পুরো প্রশ্নপত্র এ ধরনের সৃজনশীল প্রশ্নে তৈরি। (২) অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্রে ১-৩ নং পর্যন্ত প্রশ্ন পাঠ্যবই অন্তর্ভূক্ত অনুচ্ছেদ কেন্দ্রিক, ৪ ও ৫ নং প্রশ্ন পাঠ্যবই বহির্ভূত অনুচ্ছেদ-ভিত্তিক তৈরি এবং অবশিষ্ট ৬-১৬ নং পর্যন্ত প্রশ্নসমূহ নমুনা হিসেবে পাঠ্যবই-এর দু’এক জায়গায় থাকলেও একেবারে অপর্যাপ্ত। তাই একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে নিজেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের আলোকে তৈরি করতে হলে পাঠ্যবই নয়, একাধিক প্রকাশনীর গাইড বই কিনতে হয়, যেখানে প্রণীত প্রশ্নপত্রের আলোকে ৩০-৪০টি মডেল প্রশ্ন দেয়া থাকে। এ চিত্র চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সকল বিষয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উল্লেখ্য, যে যৎসামান্য দ’একটি সৃজনশীল প্রশ্ন পাঠ্যবই এ দেয়া থাকে, তা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সরবরাহ করা আইনত নিষিদ্ধ। কাজেই একজন শিক্ষক শ্রেণিতে একটি বা দুইটি প্রকাশনীর গাইড বইকে পাঠ্য করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে বাধ্য হয়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে ডোনেশন নিয়ে অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকরা অনৈতিকভাবে উপটৌকন নিয়ে নিম্নমানের গাইড বই পাঠ্য করে থাকে। ফলে এনসিটিবি কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যবই বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকে। এমনকি শিক্ষকদেরকেও নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করার জন্য চার-পাঁচটি প্রকাশনীর গাইড বই সংগ্রহ করতে হয়। অর্থাৎ, শিক্ষা যেন জ্ঞানময় নয়, গাইডময়।

লক্ষ্যণীয় যে, বিভিন্ন উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি ছুটি থাকে মোট ৮৫ দিন, সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন, অন্তঃপরীক্ষা ৩০ দিন, পাবলিক পরীক্ষা ৩০ দিন, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ১০ দিন ও সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ ৫ দিন সর্বমোট ২১২ দিন অর্থাৎ ৫৮% দিন  শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেকে বিরত থাকতে হয়। সুতরাং, বছরের ৪২শতাংশ দিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করে ১৩/১৪টি পাঠ্যবইয়ের বিশাল সিলেবাস সম্পন্ন করা কখনও সম্ভব নয়। অতএব, শিক্ষার্থীদের সিলেবাস সম্পন্ন করতে হলে গাইড বইয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বা কোচিং এ দৌড়াতে হয়। এছাড়া, সংখ্যাতিরিক্ত পাঠ্যবই-এর পাশাপাশি বিশাল সিলেবাস শিক্ষার্থীদের উপর চাপের সঞ্চার হচ্ছে। যেমন: ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি শ্রেণিতে ১৩/১৪ টি বিষয়, পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বই-এ গদ্য ও পদ্যের সংখ্যা- ২৪টি এবং একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে ১৫টি ইউনিট এর মধ্যে ৫৭টি পাঠ(লেসন) ইত্যাদি। 

উপরোক্ত,টপিক একই শ্রেণির দ’তিন পাঠ্যবইয়ে পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেমনঃ ৭ম শ্রেণিতে জলবায়ু পরিবর্তন ‘ইংরেজি ১ম পত্র’,‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ ও ‘সাধারণ বিজ্ঞান’ পাঠ্যবইয়ে পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া রয়েছে পাঠ্যবইয়ে ছাপার ভুল এবং গাণিতিক সমস্যায় ভুল প্রশ্ন ও ভুল উত্তর ইত্যাদি; যা এনসিটিবি এবং প্রকাশনার দায়িত্বহীনতার পরিচয় ছাড়া কিছুই নয়। এছাড়া  এইচএসসি পরীক্ষা যেহেতু প্রতিবছর ১ এপ্রিল শুরু হয়, তাই একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থীর দুই বছরে অধ্যয়ন কালঃ ৩৬৫+২৭৩=৬৩৮ দিন। অর্থাৎ, তাদের ১৩ টি বিষয়ে অধ্যয়নের গড় সময় = ৬৩৮/১৩=৪৯.০৭ দিন।  অতএব,শুধু আইন করে গাইড, প্রাইভেট ও কোচিং-এর রমরমা ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয় বাস্তব পদক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী। এ লক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আমার কিছু সুপারিশ :

প্রশ্নপত্র প্রণয়ণে পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়ভিত্তিক অনুশীলনী থেকে সরাসরি ৬০%, পাঠ(লেসন) থেকে ৩০% এবং পাঠ্যবইয়ের সামঞ্জস্য রেখে বর্হিভূত হিসেবে ১০% ব্যবহার করা যেতে পারে।

সৃজনশীল প্রশ্নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নব্যাংক তৈরি করে সরবরাহ করা যেতে পারে।
পাঠ্যপুস্তকে অধ্যায়/ ইউনিট সংখ্যা কমিয়ে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান পদ্ধতি প্রাণবন্ত করা অপরিহার্য ।
পাঠ্যবইয়ের সহযোগী হিসেবে এনসিটিবি কর্তৃক অনুমোদিত একটি বা দুইটি পাঠ সহায়িকা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য সরবরাহ করা যেতে পারে।
প্রকাশকদের কথা বিবেচনা করে বিষয় বা শ্রেণিভিত্তিক পাঠ্যবই ও পাঠসহায়িকা প্রকাশনার জন্য একটি বা দুইটি প্রকাশককে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে অন্ততঃপক্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যেতে পারে। এতে ধনী-গরীব, আমলা, এমপি, মন্ত্রী সকল শ্রেণির লোকদের সন্তান একই সিস্টেমে একই টেবিলে বসে শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট উন্নয়ন ঘটবে। গাইড, নোট, প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষে সহজতর হবে।
জাতীয় দিবস ছাড়া সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জড়ানো উচিত নয় বলে আমি মনে করি। এমনকি জাতীয় পর্যায়ে সকল সহশিক্ষা কার্যক্রম বছরের শুরুতেই স¤পন্ন করা যেতে পারে।।
নৈতিক গুণসম্পন্ন ও মেধাবীদেরকে “শিক্ষক পেশায়” আকৃষ্ট করতে এবং এ পেশাকে মর্যাদাবান করার লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র ও উন্নততর স্কেল প্রদানসহ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা জাতীয়করণ করা যেতে পারে। এর ফলে শিক্ষকদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থাকবে না।

লেখক: উপাধ্যক্ষ, চান্দিনা রেদোয়ান আহমেদ  কলেজ, কুমিল্লা

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062210559844971