ছাত্ররাজনীতি-সংগঠন : নিষিদ্ধ নয় হাত সরাতে হবে দলকে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর ছাত্ররাজনীতি বন্ধ বা নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে সে বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক, রাজনীতিক ও সাবেক ছাত্রনেতা। তাঁরা বলছেন, ছাত্রসংগঠন বা রাজনীতি নিষিদ্ধ করা নয়, ছাত্রদের ওপর  থেকে মূল দলগুলোর হাত সরাতে হবে। রোববার (১৩ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯০(খ) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নিয়ে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকবে না। কিন্তু এই আইন দলগুলো কেয়ার করে না। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নামে মূল দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন চালু রয়েছে। এটাকে আমি ছাত্ররাজনীতি বলতে চাই না। এটা হচ্ছে ছাত্রদের ব্যবহারের রাজনীতি। এর মাধ্যমে ছাত্রদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে। এই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ছাত্রদের অবশ্যই রাজনীতি করার, সংগঠন করার অধিকার আছে। তাদের চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার আছে।’

রাজনীতি বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু এ বিষয়ে বলেন, ‘সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে  সমিতি ও সংঘ গঠন নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে সরকার অবশ্য আইন দ্বারা কোনো সংগঠন নিষিদ্ধ করতে পারে। সন্ত্রাসী ও উগ্র ধর্মান্ধ সংগঠন সে কারণে নিষিদ্ধ হয়।

দেশের কোনো ছাত্রসংগঠন ওই কাতারে নেই যে নিষিদ্ধ করতে হবে।’ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন শিক্ষার অধিকার ছাড়াও জনগণের অধিকার আদায়, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রগতিমুখী পরিবর্তন আনতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। তখন ‘ছাত্র আন্দোলন’ বলা হতো। এখনকার মতো ‘ছাত্ররাজনীতি’ নয়।”

বর্তমান সমস্যার সমাধান সম্পর্কে মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘রাজনৈতিক দল শিক্ষাঙ্গনের বা ক্যাম্পাসের কোনো ছাত্রসংগঠনে নাক গলাবে না, পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্ব করবে না। ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের ছাত্র-ছাত্রী অন্য নাগরিকদের মতোই রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারে। তবে ওই পরিচয়ে ক্যাম্পাসে কোনো তৎপরতা করবে না। রাজনৈতিক দল ছাত্র সদস্যদের নিয়ে দলের ছাত্র ব্রিগেড গঠন করতে পারে। যেমন রাজনৈতিক দলের নারী কর্মী, যুব কর্মী, শ্রমিক কর্মী তেমনি ছাত্র কর্মী। ক্যাম্পাসে তাদের কোনো কাজ নেই। কখনো ক্যাম্পাসে নিজ দলের পক্ষে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রচার চালাতে চাইলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে অনুমতি নিতে হবে।’ তিনি লিখেছেন, ‘ছাত্রদের সংগঠন ক্যাম্পাসভিত্তিক বা জাতীয়ভিত্তিক থাকতে পারে। রাজনৈতিক অভিমত তারাও প্রচার করতে পারে তবে তাদের কাজের ক্ষেত্র হবে ছাত্রদের শিক্ষাজীবনের বিষয়গুলো—শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, বিতর্ক, ম্যাগাজিন প্রভৃতি। এসব নিয়েই প্রতিযোগিতা হবে। ছাত্রসংসদের নির্বাচনে ব্যক্তিগত বা সংগঠনের পরিচয়ে প্রার্থিতা চলবে।’

গত শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামে এক সভায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে কথা বলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ষাটের দশকের এই ছাত্রনেতা বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হত্যার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। তার মানে এই নয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আমি, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাই ছাত্ররাজনীতি করেছেন। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে হবে, এটা মানতে আমি রাজি নই। যখনই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হবে তখনই মৌলবাদীরা সুযোগ নেবে। অতীতে এটাই হয়েছে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কোনো কারণ নেই। আমি মনে করি, বুয়েটের সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে অনেক সময় শৃঙ্খলায় আনার জন্য যে সিদ্ধান্ত তাকে স্বাগত জানাই। তবে বুয়েটে যেন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করায় সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান না ঘটে, সেই বিষয়ে প্রশাসনকে নজর রাখতে হবে।’

আবরার হত্যার জন্য ছাত্ররাজনীতিকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না বলে মনে করেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বর্তমান সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, ‘বরং ছাত্ররাজনীতি না থাকার কারণেই আবরার হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। এই জন্য সমাধান হলো—ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, দুর্বৃত্তায়িত শক্তিকে অপসারণ করে এবং ছাত্ররাজনীতি স্বাধীনভাবে করতে দিতে হবে। ছাত্ররাজনীতি কমানো নয়, তা উন্মুক্ত করে দেওয়াই হবে সমাধান।’ তিনি আরো বলেন, বুয়েটে এমনিতেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে আছে, নতুন করে রাজনীতি নিষিদ্ধ করাটা ‘একটা মুরগি দ্বিতীয়বার জবাই করার’ মতো।

বুয়েট কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করেন ষাটের দশকের শেষ ভাগে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকা বর্তমান হাসানুল হক ইনু। জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, ‘তবে জাতীয় পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কোনো গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হবে না।’

ছাত্র অঙ্গনে রাজনৈতিক চর্চার অধিকার ‘সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার’ বলে উল্লেখ করেন ইনু। তিনি বলেন, ‘সুতরাং বুয়েট স্থানীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে সাময়িক সময়ের জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছি। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই।’

ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুস্তাক হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে তার সঙ্গে আমি একমত। তবে যদি ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে সেখানে কথা আছে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052609443664551