ছাদখোলা ইউনিভার্সিটির নকলের মিছিলে ওরা সবাই বুবলী

আহসান কবির |

বুবলীকে ধন্যবাদ (এই বুবলী সংবাদ পাঠিকা-কাম-চিত্রনায়িকা নন। ‘সিমপ্যাথি’ কোটার সংসদ সদস্য!)। উনি নকলকে মোটামুটি মানের ‘একটা সমবায় শিল্প’ বানিয়ে ছেড়েছেন। একই পরীক্ষা উনিসহ নয়জনে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন (আটজন দিলেও সবাই ওনার নামেই পরীক্ষা দিয়েছেন)। নকল করতে গিয়ে যিনি ধরা খেলেন উনি বার বার বলছিলেন আমিই তামান্না নুসরাত বুবলী। আসলে নকলের মিছিলে ওনারা সবাই বুবলী।

নকল কিন্তু সবসময় খারাপ জিনিস না! বিশ্বাস হচ্ছে না? ছোটকালে পড়েছি মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজ হাতে টুপি সেলাই করতেন ও কোরআন নকল করতেন। এরপর নিজ হাতে লেখা নকল কোরআন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মৃত্যুর আগে করা উইল পাওয়া গিয়েছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বালিশের নীচে। (বালিশ অনেক আগে থেকেই তাহলে বিখ্যাত। রূপপুর প্রকল্পের বালিশই শুধু আলোচিত না!) উইলে লেখা ছিল-‘কোরআন’ নকলের তিনশত পাঁচ টাকা রাখা আছে আমার থলিতে। আমার মৃত্যুর দিন এই টাকা বিতরণ করে দিও ফকিরদের মাঝে। কিন্তু ভুলেও এই টাকা কাফনের কাপড় কেনা কিংবা অন্য কোন কাজে ব্যয় করো না। কারণ কোরআন নকল করে উপার্জনকে শিয়ারা ভালো চোখে দেখে না!

এরপর আসা যায় নকল ছবি প্রসঙ্গে। এক সময় হিন্দী ছবির ফ্রেম টু ফ্রেম ‘নকল’ হতো। ফ্রেম টু ফ্রেম নকল মানে ছবির কাহিনী, সংলাপ ও গানের সুর নকল অর্থাৎ হিন্দী ছবির কার্বন কপি করা কোনও বাংলা ছবি মুক্তি পেত ঘটা করে। যেমন ‘কালা আউর গোড়া’ ছবির হুবহু নকল  এদেশের ‘নিশান’ যার বিখ্যাত গান অনেকেই মনে রেখেছেন-চুপি চুপি বল কেউ জেনে যাবে! হিন্দী ‘এক রোটি’ ছবির হুবহু নকল ‘এক মুঠো ভাত’। হিন্দী ছবির ইতিহাস বদলে দেয়া ‘শোলে’র হুবহু নকল ‘দোস্ত দুশমন’! এমন হুবহু নকল ও আংশিক নকল বাংলা ছবির তালিকা কয়েক’শ হবে। অবশ্য ১৯৯২-৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হুবহু নকলের নাম বদলে যায়, বলা হতে থাকে-‘কপিরাইট ছবি’! বাংলাদেশে তুমুল আলোচিত কপিরাইট ছবির নাম ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’- যে ছবিতে চিত্র নায়িকা মৌসুমী এবং নায়ক সালমান শাহ প্রথম অভিনয় করেছিলেন।

আর বিখ্যাত চিত্র শিল্পের নকলের নাম হচ্ছে ‘রেপ্লিকা’। মোনালিসা যেটা এঁকেছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, সেটার মতো হুবহু যদি আপনি আকেন তাহলে সেটা রেপ্লিকা। নকলের তালিকায় আরো স্থান পায় কোম্পানির লোগো, বাড়ি বা মার্কেটের নকশা। এমন কী গাড়ি ও ঘড়ির মডেল আঁকাআকিতে বিস্তর নকলের অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশে পরীক্ষার হলে ‘নকলে’র রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। বলা যেতে পারে বাংলাদেশে রয়েছে নকলের দীর্ঘ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বুবলী।

বলা যেতে পারে বুবলী সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি হয়েছিলেন সিমপ্যাথী কোটায়। তার স্বামী নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান প্রতিপক্ষের হাতে প্রকাশ্যে খুন হয়েছিলেন। দেশবাসীর সহমর্মিতা ও শান্তনা পেয়েছিলেন তামান্না নুসরাত বুবলী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সর্বোচ্চ দিয়েছেন। এরচেয়ে বড় উপহার আর হতেই পারে না। সংসদ সদস্য হতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্য খুলে যাবার পর এইচএসসি পাস বুবলী আরো বড় শিক্ষা সনদের অধিকারি হতে চাইলেন। শিক্ষিত হবার স্বপ্ন থাকা ভালো। অনার্স পাস করার জন্য ভর্তি হলেন ‘ছাদখোলা বিশ্ববিদ্যালয়ে’! অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলে থাকেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় নাকি ছাদখোলা ওরফে উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ২৮ বছর বয়সী এই ছাদখোলা বিশ্ববিদ্যালয়ে (যার সময় এর জন্ম তার নাম খালেদা জিয়া। তাঁর শিক্ষাসনদ কম থাকলেও বুবলীর মতো তিনি ভর্তি হতে যাননি) একদিন ক্লাস না করেও খোলা বই নিয়ে উম্মুক্তভাবে পরীক্ষা দেয়া যায়। কেউ নকল ধরতে এলে প্রয়োজনে সেই শিক্ষককে প্যাদানী দিয়ে দৌড়ানির ব্যবস্থা রাখা হয়। এমন ঘটনা কয়েক হাজার আছে। উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অনেক শিক্ষক পরীক্ষাকেন্দ্রে সাধারণত ‘গার্ড’ দিতে যেতে চান না। বুবলীর এবারের বিএ পরীক্ষা শুরুর দিনে ছাদখোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বান্দরবান গিয়েছিলেন পরীক্ষা দেখতে। সকাল-বিকাল পরীক্ষা। সকালের পরীক্ষায় কেন্দ্রের সব শিক্ষার্থীকে বই খুলে লিখতে দেখে ক্ষুদ্ধ হয়ে কয়েকজনকে বহিষ্কার করেন। বিরতির সময় সকালের পরীক্ষায় বহিষ্কৃত শিক্ষাথীরা প্যাদানি দেয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে। বিকেলের পরীক্ষা না দেখেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বান্দরবান ত্যাগ করেন। সেটা গত মাসের কথা। আর এ মাসেই ঘটে বুবলীকা- এবং সেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকই বুবলীকান্ডের তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য হন। 

এই ছাদখোলা ইউনিভার্সিটির আরো একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায়, এসএসসি ও এইচএসসির ভুয়া সনদধারী একজন ভিডিও গ্রাফারকে সিনিয়র ভিডিও স্পেশালিস্ট পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে এই অক্টোবর মাসেই। সম্ভবতঃ এসব বাস্তবতা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তামান্না নুসরাত বুবলী স্নাতক বা গ্রাজুয়েট হতে  চেযেছিলেন। তার আট বিষয়ের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে আটজন। আসলেই নকলের মিছিলে ওনারা সবাই বুবলী। বুবলী অবশ্য একটা সমবায় খুলতে পারেন যার নাম হতে পারে-বুবলী নকল সমবায় সমিতি। প্রয়োজনে এরা নকলের ‘আয়নাবাজি’ করবে। একেকদিন একেকজন নকলবাজি করবে। সবাইকে দেখে বুবলিই মনে হবে। এখন থেকে মেয়েরা নকল করে ধরা পড়লেই সাংবাদিকরা লিখতে পারবেন কয়েকজন বুবলী ধরা পড়েছে। 
নকলের শাস্তি কমবেশি আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। যে নকল করে তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহন থেকেই বাদ দিয়ে দেয়া হয়। কাউকে কাউকে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও করা হয়। সেনা নৌ ও বিমানবাহিনীতে কেউ নকল করে ধরা পড়লে তার চাকরি চলে যায়।
বলা হয়ে থাকে এবং অনেকে বিশ্বাসও করেন যে ক্ষমতায় থাকলে বিচার হয় না, অপরাধী পার পেয়ে যায়। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর থেকে সম্ভবতঃ উল্টো দিকে যাচ্ছে দেশ। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠন থেকে পদ হারাচ্ছেন বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িতরা। ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানী, যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, যুবলীগের সম্রাট, আরমান, জিকে শামীম, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কায়সার তাদের পদ হারিয়েছেন। কয়েকজন এমপির সম্পত্তির হিসাব চেয়েছে দুদক। বিএনপির এমপি হারুন-অর-রশীদ শুল্কমুক্ত গাড়ি অবৈধভাবে বিক্রির দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড উপহার পেয়েছেন। কিন্তু তামান্না নুসরাত বুবলীর কী হবে? বিদেশি মিডিয়ায় তার নকল করার খবর খুব সুন্দর, সাবলীল ও গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে। আমরা গুরুত্ব সহকারে একটা গল্প শুনে বিদায় নেই।

মেডিকেল কলেজে গার্ডের চাকরি করতো এক লোক। বাড়তি আয়ের জন্য পরীক্ষার সিজনে সে নকল সাপ্লাই দিতো। ভালোই কেটেছে তার জীবনের দশটা বছর। হঠাৎ! তার ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলো। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির পর সে জানতে পারলো তার ছেলের পায়ের অপারেশন করাতে হবে। সে ডাক্তারের মুখোমুখি হলো। হঠাৎ তার মনে হলো ডাক্তারকে সে অনেকদিন ধরে চেনে। ডাক্তারও তাকে চিনলো। ডাক্তার বললো-আমাদের কলেজের গার্ড আজিজ ভাই না? গার্ড উত্তর দিল-হ্যা। আসছিলাম ছেলের অপারেশনের জন্য। আপনেরে দেইখা মনে হইলো এই হাসপাতালে অপারেশন করা যাইবো না। ডাক্তার জানতে চাইলেন- কেন? আমি মনোযোগ দিয়ে অপারেশন করবো। টাকাও খুব কম নেব।
গার্ড উত্তর দিল- যখন পড়ালেখা করতেন তখন মনোযোগি হইলেই ভালো করতেন। আমি নকল সাপ্লাই না দিলে তো আপনি পাসই করতেন না। আমি নকল কইরা ডাক্তারি পাসকরা ডাক্তাররে দিয়া আমার ছেলের পা অপারেশন করামু না!

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ‘সিমপ্যাথি’ সব সময়ে ভালো জিনিস বয়ে আনে না। যেমন-এক লোক পাঁচ বছর হলো বিয়ে করেছে। তার কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। সে কয়েকবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। সব ডাক্তারই তাকে বলে দিলেন তার বাবা হবার ক্ষমতা নেই। ঐ লোকের বউ এরপর গেলেন এক ভন্ডপীরের কাছে। পীর বললেন-হবে। এক দেড় বছরের মধ্যেই সন্তান হবে। বাস্তবে হলোও তাই। সন্তান হবার পরে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। মন খারাপ হলো শুধু স্বামী বেচারার। সে এক রাতে বউয়ের কাছে জানতে চাইলো-তুমি যে পীর সাহেবের কাছে গেলা আর সন্তান পাইলা, এখন আমারে বলো পীরসাহেব তোমারে কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা দিছে? হোমিওপ্যাথি নাকি অ্যালোপ্যাথি?
বউ খানিকক্ষণ ভাবার পর বললো-চিকিৎসার এই পদ্ধতির নাম ‘সিমপ্যাথি’!!!

 

লেখক: আহসান কবির, সাংবাদিক, অভিনেতা ও রম্যলেখক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036449432373047