জবরদস্তির বোনাস ও সরকারিকরণের গল্প

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আমলাতন্ত্র নিয়ে বহু আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কত কথা যেন পড়েছিলাম৷ গণতন্ত্রের জন্য এটি অনেক সময় হুমকি৷ আমলারা কোনো কোনো সময় সরকারকে পর্যন্ত নাকানি চুবানি খাইয়ে থাকেন৷ সময় বিশেষ সরকারও তাদের কাছে অসহায়৷ এমপি-মন্ত্রীরা রাজনীতিতে পরিপক্ব হলেও দেশ পরিচালনায় ততটা দক্ষ নাও হতে পারেন৷ আমলারা সে সুযোগটুকু নেয়৷ তারা শিক্ষা-দীক্ষায় অভিজ্ঞ মানুষ৷ এমপি-মন্ত্রিগণের অতশত প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাও থাকতে পারে৷ তদুপরি আমলাদের ক্ষমতার আরেকটি কারণ হলো- মন্ত্রী বা এমপিগণ জনগণের আস্থা হারালেই শেষ৷ কিন্তু আমলারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই থাকেন৷ জনসাধারণের আস্থা কিংবা অনাস্থায় তাদের কিছু যায় আসে না৷ সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু আমলারা আগের মতো বিদ্যমান থাকেন৷

যতদূর মনে পড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আমলাতন্ত্র অধ্যায়ে এরকম একটি ইংরেজি বাক্য পড়েছিলাম- 'Minister may come and minister may go but the official remains in the office.' এ কারণে তাদের খুঁটির জোর খুব শক্ত৷ যে কোনো সময় সরকারের পতন ঘটে যেতে পারে৷ কিন্তু তাদের ক্ষমতা হারাবার ভয় নেই৷

সম্প্রতি সরকারিকরণ ও ঈদ বোনাস নিয়ে দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তির মন্তব্যে শিক্ষকদের অনেকেই নানাভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। তবে, ওই বক্তব্যটির সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে আলাপচারিতায় সিনিয়র সচিব এমন কথা বলেছেন বলে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। প্রতিবেদক ঠিকমতো সচিবের কথার বরাত দিয়েছেন কি-না, তা জানার আমাদের সুযোগ হয়নি। খণ্ডিত বক্তব্য প্রকাশ করলে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকতে পারে।

শিক্ষক সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে বিগত বিএনপি সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের  যথাক্রমে ২৫ শতাংশ  ও ৩০ শতাংশ ঈদ বোনাস দেয়া শুরু করে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি হয়। এরপর থেকে নিয়মিত পেয়ে আসছেন। বিএনপি ক্ষমতা থেকে গেছে সেই ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে। তারপর গঙ্গার জল গড়িয়েছে অনেক কিন্তু কোনো শিক্ষক নেতা সেই ৫০ শতাংশকে শতভাগে উন্নীত করতে পারেননি। এমনকি বোনাস নিয়ে আমলাদের নেতিবাচক মন্তব্যের পর কোনো প্রতিবাদও দেখা যায়নি। কারণ, পদ-পদবি, বেসরকারি শিক্ষক হয়েও মন্ত্রণালয়ের গাড়ী ও লোগো ব্যবহার করা যদি বন্ধ হয়ে যায়!

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য কেউ জোর-জবরদস্তি করেন সেটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়৷ অন্তত তাদের পক্ষ হয়ে কেউ একটু দেন দরবার বা জোর-জবরদস্তি করলে ৫শ’ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাসের যন্ত্রণা তাদের সইতে হতো না৷ মানুষ গড়ার কারিগর হয়েও লজ্জাবনত জীবন যাপন করতে হতো না৷

‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’- স্লোগানটিকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করার জন্যে কারা উঠে পড়ে লেগে আছে, সেটি শিক্ষক-কর্মচারীরা ভালো করেই জানেন৷ আর এ কারণেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বোনাস সরকারের না দেবার কথা বলে নিজেদের দায়মুক্তির অপপ্রয়াস৷ এ কথায় সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া একান্ত স্বাভাবিক৷

সিনিয়র সচিব মহোদয়কে সবিনয়ে বলতে চাই- বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীগণ আন্দোলন-সংগ্রাম করে একদিন ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস আদায় করেছিলেন৷ আন্দোলন-সংগ্রাম করে করেই আরেকদিন ষোল আনা বোনাস আদায় করে ছাড়বেন তাঁরা৷ সেদিনটি হয়ত খুব বেশি দূরে নয়৷ 

প্রসঙ্গত, বিএনপি আমলে যখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ২৫ শতাংশ উৎসব বোনাস দেবার সিদ্ধা ন্ত হয় তখন তারা সরকারি স্কেলের ৯০ শতাংশ বেতন পেতেন৷ বহু আন্দোলন-সংগ্রামের বিনিময়ে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করার ঘোষণা দেয় শর্ত সাপেক্ষে। শর্ত হলো প্রতিষ্ঠানের আয় সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার। কিন্তু তৎকালীন নেতারা এর বিরোধীতা করেন। ফলে বিএনপি সরকার ৯৫ শতাংশ ((৯০ + ৫) বাস্তবায়ন করে  ক্ষমতা ছাড়ে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে।

সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীগণ প্রতি তিন বছর অন্তর একটি শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পেলেও বেসরকারিদের কপালে আজ পর্যন্ত সেটি জোটেনি৷ এ নিয়ে কেউ কোনদিন টু শব্দ পর্যন্ত করেনি৷ এ বিষয়ে মাননীয় সচিব মহোদয় দয়া করে কি একটু জোর জবরদস্তি করবেন?

গত ৩১ জুলাই বুধবার মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক সিলেট অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে শিক্ষার মানোন্নয়ন বিষয়ক এক মতবিনিময় সভা করেন৷ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের উদ্যোগে শহরের কবি নজরুল অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় মহাপরিচালক মহোদয় শিক্ষার নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন৷ সরকারিকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারিকরণের জন্য টাকা কোনো ফ্যাক্টর নয়; ফ্যাক্টর ম্যানেজমেন্ট৷ তার বক্তব্যটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারও হয়েছে। মহাপরিচালকের সাথে দেখা করে বেসরকারি শিক্ষকরা ফুল দিয়েছেন, সেলফি তুলে ফেসবুকে দিয়েছেন। কিন্তু সাহস করে কেউ শতভাগ বোনাস বা বাড়ীভাড়া চাননি। ওই কাজটি সাংবাদিকদের জন্যই রেখে দিয়েছেন। ফেসবুকে যারা ঝড় তোলেন তারা কিন্তু কাছে পেয়েও মহাপরিচালককে তাদের দাবি বলতে পারেননি।

আমার কথা এই যে, টাকা যদি কোনো ফ্যাক্টর না হয়ে থাকে তবে সরকারিকরণ হবার আগ পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা ইত্যাদি সরকারিদের মতো দিতে সমস্যা কোথায়? আর ম্যানেজমেন্টের যে কথাটি এসেছে সে ক্ষেত্রে দূর্বল ম্যানেজমেন্টের কথা বলে জাতিকে সরকারিকরণ থেকে বঞ্চিত করা কতটুকু সমীচীন? 

ম্যানেজমেন্ট উন্নত করা শিক্ষক-কর্মচারী বা জনগণের দায় নয়; এটি সরকারের কাজ৷ দক্ষ ও চৌকস প্রশাসন গড়ে তোলা সরকারেরই দায়িত্ব৷ আমাদের জাতির পিতা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় কোন ম্যানেজমেন্টের বলে প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ করেছিলেন? জ্বলা-পোড়া অর্থনীতি এবং একটি দূর্বল ও অদক্ষ ম্যানেজমেন্টের ওপর দাঁড়িয়ে কেবল সদিচ্ছার বলে বঙ্গবন্ধু যদি প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ করতে পারেন তবে স্বাধীনতার অর্ধ শত বছর পর স্বনির্ভর অর্থনীতি নিয়ে অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর সরকারিকরণ করা যাবে না কেন? 

ঈদুল আযহা সমাগত৷ এটি মুসলমানদের বড় ঈদ৷ এ ঈদে পশু কোরবানি দিতে হয়৷ এর মাধ্যমে নিজের ভেতরের পশুটাকে কোরবানি করা লাগে৷ নিজের মধ্যেকার দীনতা ও হীনতাকে পরিহার করার শিক্ষা দেয় এই কোরবানির ঈদ৷ অনেকেই কোরবানির পশু কিনে ফেলেছেন৷ কেবল বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ছাড়া৷
তারা বেতন-বোনাস কিছুই এখনও পাননি৷ ঈদের এক-দু’দিন আগে পেতে পারেন৷ না-ও পেতে পারেন৷ এ আরেক যন্ত্রণা তাদের৷

সিকি আনা ঈদ বোনাস! অন্তত বেতনসহ সেটিও যদি ঈদের এক সপ্তাহ আগে তারা হাতে পেতেন৷ তাহলে কেউ কেউ হয়ত একটা খাসি কিনতে পারতেন৷ এক-দু’নাম কোরবানি দিতে পারতেন৷ সেটুকুও হয়ত অনেকের পক্ষে সম্ভব হবে না৷ আনন্দের ঈদ অনেকের কাছে যন্ত্রণার ঈদ হয়ে উঠে৷ সিকি বোনাস নিপাত যাক৷ ষোল আনা বোনাস ও সরকারিকরণের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক সব বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর হৃদয় ও মন৷

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক৷


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033130645751953