ইডেন মহিলা কলেজজমজমাট সিট বাণিজ্য ছাত্রলীগ নেত্রীদের

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের ঐতিহ্যবাহী কলেজ রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ। স্কুল হিসেবে ১৮৭৩ সালে যাত্রা শুরু করে কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ১৯২৬ সালে। বর্তমানে ২৩টি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষক আড়াই শতাধিক। শ্রেণিকক্ষ, পরিবহন সংকট, সেশনজটের পাশাপাশি নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে এই কলেজের শিক্ষার্থীরা।

সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে হলে থাকা শিক্ষার্থীরা। হলে কলেজ কর্তৃপক্ষের বরাদ্দের বাইরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে জমজমাট সিট বাণিজ্য। হলে সিট বরাদ্দ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরও ছাত্রলীগ নেত্রীদের অনুশাসন মেনে চলতে হয়। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন ও মাসুদ রানা।

ইডেন মহিলা কলেজে আবাসিক হলের সংখ্যা ছয়। খোদেজা খাতুন ছাত্রীনিবাস, বানেছা বেগম ছাত্রীনিবাস, আয়েশা সিদ্দিকা ছাত্রীনিবাস, রাজিয়া ছাত্রীনিবাস, জেবুন নেছা ছাত্রীনিবাস এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাস।

এই হলগুলোতে আসনসংখ্যা তিন হাজার ৩২০। তবে এসব হলে থাকছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী। আসনসংখ্যার বাইরের প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীর বেশির ভাগকে ছাত্রলীগ নেত্রীদের পাঁচ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত এককালীন দিয়ে হলে উঠতে হয়েছে।

এরপর মাসিক ও বার্ষিক ভাড়া তো পরিশোধ করতেই হয়। প্রায় প্রতিটি হলে চার সিটের রুমে থাকছে আটজন শিক্ষার্থী। আর আট সিটের রুমে থাকছে ১২ থেকে ১৬ জন পর্যন্ত। প্রত্যেক হলেই রয়েছে কিছু গণরুম। সেসব রুমে থাকে অসংখ্য শিক্ষার্থী।

রাজিয়া হলে ২২টি কক্ষে ৩৩০ জন শিক্ষার্থী থাকে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের ৫২টি কক্ষে থাকে প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী। প্রতিটি হলেই রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। শিক্ষার্থীরা সাধারণত নিচ থেকে পানি সংগ্রহ করে। তাতেও রয়েছে আয়রন। প্রতিটি হলে ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা পরিচালিত হয় ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। ডাইনিংয়ের খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপায় নেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

কজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানায়, আসন বাণিজ্যের পাশাপাশি ছাত্রলীগ নেত্রীদের ভয়ে থাকতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ছোটখাটো অজুহাতে মারধরের শিকার হতে হয়। হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ জন্য শিক্ষার্থীরা অনিয়মের প্রতিবাদ করে না। এসব বিষয়ে কাউকে কিছু বলতেও নিষেধ রয়েছে।

হলের সিট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। নেত্রীদের কক্ষ নির্দিষ্ট করা আছে। সেখানে তিনি কতজন রাখবেন সেটা তাঁর ব্যাপার। এ ছাড়া অনেক সময় কোনো নেত্রীর টাকার প্রয়োজন হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা হয়। না গেলে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়।

জেবুন নেসা ছাত্রীনিবাসের একজন ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি এককালীন সাত হাজার টাকা দিয়ে হলে উঠেছি। প্রথমে চারজন থাকলেও পরে আমাদের রুমে আটজন তোলা হয়। আর কর্তৃপক্ষকে বার্ষিক সাত হাজার টাকা তো দিতেই হয়।’

রাজিয়া হলের এক শিক্ষার্থী জানান, হলে সুযোগ-সুবিধার চেয়ে বেশি পোহাতে হয় দুর্ভোগ। আর ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ম মেনে হলে থাকতে হয়। ব্যত্যয় ঘটলে নানা সমস্যায় পড়তে হয়।

ইডেন কলেজে বর্তমানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। সদ্য সাবেক কমিটির আহ্বায়ক তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘হলের সঙ্গে নেত্রীদের কোনো ইনভলভমেন্ট নেই। ডিপার্টমেন্ট থেকেই ফল ও আর্থিক সচ্ছলতা বিবেচনা করে শিক্ষার্থীদের হলে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে আমার রুমে আটজন লিগ্যাল ছাত্রী আছে, কিন্তু থাকছে ১২ জন। আমাদের আদর্শের সঙ্গে যারা আছে, অথচ থাকার জায়গা নেই, তাদের জন্য আমরা একটা ব্যবস্থা করি।’ তিনি বলেন, ‘দেখা যায়, এভাবে অনেক রুমে ফ্লোরিং করে কিছু শিক্ষার্থী থাকছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেওয়া হয় না। আমি আহ্বায়ক হওয়ার পর সব বন্ধ করে দিয়েছি।’

শ্রেণিকক্ষ সংকট : ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ৭২টি। কলেজের বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা চলাকালে ক্লাস বন্ধ থাকে। এসব ক্লাস মাঝেমধ্যে বিকেলে নেওয়া হয়। অনেক সময় নেওয়া হয় না। যারা অনেক দূর থেকে কলেজে আসে, তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শ্রেণিকক্ষ সংকটে অনেক সময় শিডিউল ক্লাসও নেওয়া যায় না।

অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানা আক্তার বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিতে চান। কিন্তু শ্রেণিকক্ষ সংকটে মাঝে মাঝেই সমস্যা হয়। এ ছাড়া কোনো বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা থাকলে তখন বিকেলে ক্লাস হয়। আবার অনেক সময় হয় না।’

ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী চন্দ্রা রানী বলেন, ‘আমি পুরান ঢাকা থেকে ক্লাস করতে আসি। পরীক্ষার কারণে ক্লাস বিকেলে হলে আর আসতে পারি না। এদিকে ক্লাসে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলে পরীক্ষা দিতে দেয় না।’

পরিবহনস্বল্পতা : ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য কলেজটির বাস রয়েছে মাত্র দুটি, যেগুলো মাত্র কয়েকটি রুটে চলে। এসব রুটের বাইরের শিক্ষার্থীদের পাবলিক বাসে করে কলেজে আসতে হয়। এই শিক্ষার্থীদের প্রায় সময়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

ইংরেজি বিভাগের জান্নাতুল ফেরদাউস বলেন, ‘আমাদের কলেজে পরিবহন সমস্যাটি বড় সমস্যা। এ ব্যাপারে কলেজ কর্তৃপক্ষ নীরব। বর্তমানে যে দুটি বাস আছে তাতে দাঁড়িয়ে, ঝুলে, গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীরা আসা-যাওয়া করে। অনেক সময় আমাদের সহপাঠীরা দুর্ঘটনার শিকারও হয়েছে।’

সেশনজট প্রকট : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অন্যান্য কলেজের মতো ইডেন কলেজেও সেশনজট প্রকট। পরীক্ষার ঠিক ঠিকানা নেই। আর পরীক্ষা হওয়ার পরও ফল প্রকাশ হয় না। কবে শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্স শেষ করতে পারবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিটি বর্ষেই বর্তমানে দুটি করে ব্যাচ রয়েছে।

আভা আক্তার নামের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি ২০১১ সালে অনার্সে ভর্তি হয়ে এখনো পাস করে বের হতে পারিনি। অন্যদিকে আমার বন্ধুরা যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, মাস্টার্সও করে ফেলেছে।’

জ্যোতি নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তির পর ফলে ধস নেমেছে। অনেক বিভাগে ২-৩ শতাংশের বেশি পাস করছে না। একে তো সেশনজট, আবার ফলে ধস, সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি।’

নেই ছাত্রসংসদ : দীর্ঘদিন ধরে ইডেন কলেজে নেই ছাত্রসংসদ। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের নেত্রীরাই অধিপত্য বিস্তার করেন। নাম প্রকাশ না করে একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের কলেজে ছাত্রসংসদ দরকার। এটা হলে ছাত্রলীগের হাত থেকে একটু হলেও রেহাই পওয়া যেত।’

অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শামসুন নাহারের সঙ্গে গত মঙ্গলবার কলেজটির নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00388503074646