জাতীয়করণ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়

মো. আবুল হোসেন |

শিক্ষিত জাতি দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই শিক্ষিত জাতি তৈরি করে শিক্ষক সমাজ। তাই শিক্ষকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করলে দেশ পিছিয়ে যেতে বাধ্য। শিক্ষকদের যদি পিছুটান না থাকে তাহলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। দেশে শিক্ষিত এবং কর্ম দক্ষতার হার বৃদ্ধি পাবে।

শিক্ষিত জাতি গঠনে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা একান্ত  প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন না এনে উন্নত জাতি গঠন সম্ভব নয়। শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বৈত নীতি  থাকার কারণে আজ শিক্ষকদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে বিভাজন এবং অসন্তোষ। শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রিমুখী অবস্থা বিরাজমান থাকলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক এবং ননএমপিও শিক্ষকদের জাতীয়করণের আওতায় এনে শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল করলে শিক্ষায় প্রাণ ফিরে পাবে।
 
বেসরকারি এমপিও শিক্ষক এবং ননএমপিও শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এটি শুভলক্ষণ নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

শিক্ষাব্যবস্থায় অসঙ্গতির ফলে প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে; যা কারোর কাম্য হতে পারে না। শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে বিরাট তফাৎ রয়েছে। যেমন- সরকারি শিক্ষকরা যা পান বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের ধারে-কাছেও নেই।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাব্যবস্থার গতি বাড়াতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়- বেসরকারি শিক্ষকরা পাবেন ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা। যা সত্যিই প্রসংশনীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সরকারি শিক্ষকরা ঠিকই পেয়েছিল সঠিক সময়ে। অপরদিকে, বেসরকারি শিক্ষকরা আন্দোলনের মাধ্যমে পেয়েছেন তিন বছর পর। এ অবস্থার কারণে কিছুটা হলেও শিক্ষক অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছিল। শিক্ষকরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, অনশন করা সত্যিই বেদনাদায়ক।  বেসরকারি শিক্ষকদের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে তা থেকে আবার অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করা হচ্ছে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট্রের জন্য, এতেও দ্বৈত নীতি অবলম্বন করা হয়েছে।

অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য পূর্বে কাটা হতো ৬ শতাংশ, এখন কাটা হচ্ছে ১০ শতাংশ। অতিরিক্ত কোনো সুযোগ সুবিধা না দিয়ে পূর্বে যা ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। ৬ শতাংশ কর্তনে অবসর ও কল্যাণ তহবিলে মোট (৭৫+২৫) বা ১০০ মাসের বেতনের সমান সর্বশেষ স্কেল অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য; সেই অনুযায়ী এখন ১৭৫ মাসের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা না করেই অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করা হচ্ছে;  এমনটা মেনে নেওয়া বড়ই কষ্টের। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য পেনশনের সুযোগ-সুবিধা রাখার জোর দাবি জানাচ্ছি। যেহেতু সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশনের আওতায় আনা হবে। যেখানে বহির্বিশ্বে শিক্ষকদের দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সম্মান এবং মানসম্মত বেতন। আর বাংলাদেশের শিক্ষকরা বিভাজিত সরকারি, বেসরকারি, ননএমপিও এই তিন ভাগে। যার ফলে বেতনের মধ্যেও চরম বৈষম্য।
 
বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, ইদ বোনাসের মধ্যেও পার্থক্য ব্যাপক। বাড়ি ভাড়া সরকারি শিক্ষকরা পান ৪৫-৬০ শতাংশ আর বেসরকারি শিক্ষকরা তা পান মাত্র ১০০০ টাকা। চিকিৎসা ভাতা সরকারি শিক্ষকরা পায় ১৫০০ টাকা আর বেসরকারি শিক্ষকরা পায় ৫০০ টাকা। ইদ বোনাস সরকারি শিক্ষকরা পান ১০০ শতাংশ আর বেসরকারি শিক্ষকরা পান মাত্র ২৫ শতাংশ । এই দ্বৈত নীতি পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। তবে এই অবস্থার অবসান না হলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়।

উন্নত জাতি গঠনে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা  জরুরি। এই জন্য প্রয়োজন সমগ্র বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণের আওতায় আনা এবং দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ শিক্ষক পেতে জাতীয়করণ অবশ্যই প্রয়োজন।  শিক্ষকদের পেটে ক্ষুধা রেখে প্রকৃত শিক্ষা আশা করা যায় না। আগে শিক্ষকদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে। তাহলেই প্রকৃত শিক্ষায় দেশ শিক্ষিত হবে।
 
বেসরকারি শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে স্বল্প সুদে হাউজ লোন পাওয়ার ব্যবস্থা করা একান্ত কাম্য। যেহেতু সরকারি শিক্ষকরা স্বল্প সুদে হাউজ লোন পায়। তবে কেন বেসরকারি শিক্ষকরা তা থেকে বঞ্চিত হবে?
 
সমগ্র স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের জোর দাবি জানাচ্ছি। বেসরকারি শিক্ষকরা বদলি হতে পারবেন কিন্তু সরকারি শিক্ষকদের মতো নয় । বেসরকারি শিক্ষকরা শুধু শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন করে বদলি হতে পারবে কিন্তু সেই নিয়োগ দিবে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি। তাহলে সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য রয়েই গেল।
 
সরকারি যেমন এক জনকে বদলি করে আরেক জনকে আনা যায়; বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় তা করা হবে না। শুধু শূন্য পদের বিপরীতে নেওয়া হবে। সরকারি শিক্ষকরা পান বেতন; বেসরকারি শিক্ষকরা পান অনুদান বা সরকারি অংশ, এটা সৎ মায়ের মতো আচরণ।  লেখা পড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য চাই সমগ্র বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ।

শিক্ষকদের রাস্তায় নামতে হয় দাবি আদায় করার জন্য। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষাব্যবস্থায়। এতে করে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।  যা কখনও কোনো উন্নত দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না।

আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষক, সবার মর্যাদা তাই সমান চাই। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য মেনে নেওয়া যায় না। এ অবস্থা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কল্যাণকর নয়। শিক্ষাব্যবস্থার অসঙ্গতির কারণে  শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে সঠিক পাঠদান থেকে। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণের প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছে।
 
পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়। শিক্ষকরা হারাচ্ছেন পাঠদানের প্রতি মনোযোগ। বৈষম্য দূরীকরণ না হলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে না। দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে অকালেই ঝরে পড়ছে। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। যা ডিজিটাল যুগে সত্যিই হতাশাজনক। সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ হলে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত সকলেই সমান সুযোগ পাবে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় গতি সঞ্চার হবে। 

যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। আর এই উন্নয়নশীল দেশ গঠনের পূর্ব শর্ত শিক্ষাব্যবস্থায় সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।

জাতীয়করণ হলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং আত্মকর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। কারণ শিক্ষিত জাতিই আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে পারে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করলে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণের প্রতি মনোযোগী হবে যা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক।
 
জাতীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ হবে এবং প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রকৃত শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে। দেশ পরিণত হবে একটি উন্নত দেশে। জাতীয়করণ হলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু অসাধু শিক্ষকের সিন্ডিকেট দূর হবে এবং কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে। যা প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থায় খুবই জরুরি। জাতীয়করণ হলে সকল পেশার মানুষ তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার সমান সুযোগ পাবে এবং দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে দেশ মুক্তি লাভ করবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।

সর্বোপরি, এক কথায় বলা যায়, জাতীয়করণই হলো সকল সমস্যার একমাত্র কেন্দ্র বিন্দু। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিনীত প্রার্থনা এই যে, আপনি বেসরকারি শিক্ষকদের  প্রাণের দাবি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা জাতিকে উপহার দিবেন; এই প্রতীক্ষায় বেসরকারি শিক্ষকরা প্রহর গুণছি। আপনিই আমাদের শেষ ভরসা। 

লেখক: মো. আবুল হোসেন, শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062961578369141