এবারের মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন সজিব চন্দ্র রায়। কাঠুরিয়া বাবা এবং দিনমজুর মায়ের সন্তান এবারের মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অসামান্য সাফল্য লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
চরম আর্থিক অস্বচ্ছলতা কোনোভাবেই থামাতে পারেনি তার অদম্য ইচ্ছা ও মেধাশক্তিকে। তবে মেডিকেলে কৃতিত্বের সাথে ভর্তির সুযোগ পেয়েও এখন তার স্বপ্ন দারিদ্র্যের কারণে বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ১১ নম্বর মরিচা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম কাঠগড় রাজাপুকুর। এই গ্রামে একটি অস্বচ্ছল পরিবারে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম সজিব চন্দ্র রায়ের।
বাবা মনোধর চন্দ্র রায় সংসারের ভরণ-পোষণের জন্য একসময় রিকশাভ্যান চালাতেন। ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে সেই রিকশাভ্যান বিক্রি করে এখন শুধু কাঠুরের কাজ করেন। এরপরও সংসারের ব্যয় সংকুলান না হওয়ায় মা চারুবালা রায়কে যেতে হয় কৃষিক্ষেত্রে দিনমজুরের কাজ করতে। সজিব চন্দ্র রায় স্বপ্ন দেখেন বড় হয়ে চিকিৎসক হওয়ার।
কৃতি শিক্ষার্থী সজিব চন্দ্র রায় দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে একবার সে চরম অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে তারা বাবা-মা। অর্থাভাবে ছেলের ঠিকমত চিকিৎসাও করাতে পারছিলেন না তারা। তখন থেকে তার ইচ্ছা বড় হয়ে চিকিৎসক হবে এবং দেশের মানুষের সেবার পাশাপাশি পরিবারকে দারিদ্র্যমুক্ত করবে।
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে চিকিৎসক হওয়ার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়েই লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে সে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও তার অদম্য ইচ্ছা আর প্রবল মেধাশক্তির ফলে এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০১০ সালে বাড়ির পার্শ্ববর্তী কাঠগড় আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় গোটা বীরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে প্রথম হন তিনি। পরবর্তীতে স্থানীয় গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে জেএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি এবং একই বিদ্যালয় থেকে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন।
২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দপুর সরকারি টেকনিক্যাল কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন সজিব। সজিবের বাবা মনোধর চন্দ্র রায় জানান, জমি বলতে বাড়ির ভিটাটুকু আর কিছুই নাই তার। আগে রিকশাভ্যান চালাতেন। পরবর্তীতে ছেলের লেখাপড়ার জন্য সংসারের একমাত্র সম্বল রিকশাভ্যানটি বিক্রি করে দেন। এখন কাঠুরিয়ার (গাছ কাটা) কাজ করে সংসারের ভরণপোষন নির্বাহ করেন তিনি।
স্বল্প এই রোজগার দিয়ে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এরই মধ্যে ছোট থেকেই ছেলে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখলে অভাবের এই সংসারে চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ছেলের কোন আবদার না থাকলেও তার একটিই আবদার বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে। ছেলের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ও ইচ্ছা মাঝে মাঝে তাকে বিমর্ষ করে। দারিদ্র্যপীড়িত এই সংসারে কী করে এটা সম্ভব?
সজিবের ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসক হওয়ার যে অদম্য ইচ্ছা-সেই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন তার শিক্ষক জহুরুল ইসলাম মানিক ও মো. হেলাল উদ্দীন।
মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার খবর পেয়ে গত সোমবার সজিবের বাড়িতে আসেন এ দুই শিক্ষক।
সজিবের শিক্ষকরা জানান, এরকম মেধাবী শিক্ষার্থী সমাজে খুবই বিরল। তবে ছোটবেলা থেকেই তার যে প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও মেধা, তাতে তারা মনে করেছিলেন, বাবা-মায়ের দারিদ্রতা তার এই ইচ্ছা শক্তিকে কখনই থামাতে পারবে না। আজ তা সত্যিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সজিব একজন ভালো চিকিৎসক হয়ে উচ্চ শিখরে আরোহণ করবে বলে এই দুজন শিক্ষকের বিশ্বাস। এ জন্য তাকে উৎসাহ যোগানো এই দুজন শিক্ষকও দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।