জিতবে কারা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী |

একটা নির্বাচন তো মনে হয় ঘনিয়ে এসেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরেই হবে বলে ধারণা। তাতে কে জিতবে, কিভাবে জিতবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা আছে; কিন্তু যে দলই জিতুক এটা নিশ্চিত যে হেরে যাবে জনগণ। নির্বাচন শেষ হতে না হতেই তারা জেনে যাবে যে তারা হেরে গেছে।

ঘটনাটা নতুন নয়। খুব বড়, একেবারে ঐতিহাসিক দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এ দেশের জনগণের আছে, একটি ১৯৪৬ সালের, অন্যটি ১৯৭০ সালের। দুটিতেই জনগণের মনে হয়েছিল যে তারা জিতেছে, ভেবেছিল তাদের মুক্তি আসবে। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল মুক্তি আসেনি। তারা হেরে গেছে। ছেচল্লিশের ঠিক আগে অখণ্ড বাংলায় একটা প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, নির্বাচন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তাতে সাফল্য যে আসেনি তা নয়। নির্বাচন হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু তার পরই দাঙ্গা, একটু পরে দেশ ভাগ। আর উনসত্তরে তো একটা অভ্যুত্থানই ঘটেছিল। গ্রামের মানুষ জেগে উঠেছিল। থরথর করে কাঁপছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান। মনে হয়েছিল বিপ্লব ঘটবে। সন্ত্রস্ত শাসকরা প্রশমন চেয়েছে, তারা নির্বাচন দিয়েছে, দ্রুতগতিতে। এ নির্বাচনও বিশ্বাসযোগ্য ছিল। কিন্তু এবারের পরিণতি দাঁড়াল আরো ভয়ংকর; দাঙ্গা নয়, সামনাসামনি যুদ্ধ। সেবার দেশ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, এবার রাষ্ট্র ভাঙল। কিন্তু জনগণের মুক্তি এলো না। এবারও তারা হেরে গেল। হারল যে সেটা কার কাছে? হারল ব্যবস্থার কাছে। ব্যবস্থাটা পুঁজিবাদী। ১৯৪৬ সালের পরে পুঁজিবাদ বিকাশের নতুন পথ পেল, ১৯৭১ সালের পরে পুঁজিবাদ তার বিকাশের পথটাকে আরো প্রশস্ত করে নিল; এখন তো তার অগ্রযাত্রা পুরোপুরি অপ্রতিহত।

কিন্তু এ রকমই কি চলবে? জনগণ কী শুধু হারতেই থাকবে? হারার কোনো শেষ থাকবে না? না; তা হবে না। জনগণ জিতবে। আগামী নির্বাচনে যে জিতবে না এটা নিশ্চিত, আগামী দশকেও জিতবে না। কিন্তু জিতবেই জিতবে। ব্যবস্থাটা অবশ্যই বদলাবে। কবে এবং কিভাবে, প্রশ্ন শুধু সেটাই।

এই আশাবাদের কারণ কী? কারণ একাধিক। প্রথম কারণ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা অনেক, তারাই নব্বই জন; তাদের তুলনায় সুবিধাভোগীদের সংখ্যা খুবই কম, ১০ শতাংশ। হ্যাঁ, এই ৯০ শতাংশ আগেও ছিল। কিন্তু তারা আগে এতটা বিক্ষুব্ধ ছিল না। বিক্ষোভের সঙ্গে মিলেছে সচেতনতা। আর এই বিক্ষোভ ও সচেতনতা কোনো এক দেশের মানুষের নয়, এটি এখন বিশ্বময়। সারা বিশ্বের বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। লড়াইটা চলছে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে। কোনো দেশের মানুষই সম্পদের ব্যক্তিমালিকানা আর চায় না, সামাজিক মালিকানা চায়। দমিয়ে দেওয়ার, দাবিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। চলবে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হবে না। নদীর ওপর বাঁধটা টিকবে না। কারণ স্রোত প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে এবং প্রবল হতেই থাকবে। বাঁধটা ভেঙে পড়বে।

আশাবাদের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন চরম জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে সে যে ভেঙে পড়েনি তার কারণ তার বুদ্ধিতে যত ছল ছিল, বাহুতে যত বল ছিল, কৌশল উদ্ভাবনায় যত দক্ষতা ছিল—সব সে খাটিয়েছে। তার আয়ত্তে এখন যা আছে তা তলানি বটে। দিশাহারা দশায় এখন সে কতটা যে বেপরোয়া সেটা বোঝা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎপরতায়। পুঁজিবাদ এখন রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে মানুষের বিক্ষোভ দমনের জন্য। রাষ্ট্র পরিণত হচ্ছে ফ্যাসিবাদী শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠানে। করতলগত মিডিয়াকে সে ব্যবহার করছে বিভ্রান্তি ও ভোগবাদিতা প্রচারের বাহন হিসেবে। ফেসবুক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার আত্মসন্তুষ্টি দানের অন্তরালে মানুষকে শুধুই পরস্পরবিচ্ছিন্ন ও অসামাজিক করে তুলছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তিমানুষের সব খবর ছেঁকে তুলছে গোয়েন্দাগিরির জন্য। বিশ্বযুদ্ধ লাগানোর কাজে ক্ষান্তি দিয়ে এখন সে স্থানীয় যুদ্ধের ব্যবস্থা করছে। সমানে চলছে মানুষ মারার অস্ত্রের উন্নয়ন। আর আছে নেশা। ধর্ম, বর্ণ, অন্ধ জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির পুরনো নেশা তো রয়েছেই, যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক নতুন নেশা, সেটা মাদকের। পুঁজিবাদ মুনাফা ছাড়া আর কিছু বোঝে না; মুনাফার প্রয়োজনে দুর্বল মানুষদের সে মজুরি-দাস বানায়। মজুরি-দাসত্ব প্রাচীন ক্রীতদাস প্রথারই আধুনিক রূপ। মানুষেরা থেকে থেকে খেপে ওঠে দেখে পুঁজিবাদীরা এখন চাইছে মানুষের বদলে যন্ত্রই তাদের হয়ে কাজ করুক। যন্ত্র কখনো অবাধ্য হবে না, এমনকি মজুরিও চাইবে না। কিন্তু যন্ত্রের রাজত্ব কায়েম হলে মানুষ যে আর মানুষ থাকবে না, মালিকরা নিজেরাও যন্ত্রে পরিণত হবে সে চিন্তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। যন্ত্রকে খাটিয়ে শ্রমিককে বেকার করলে লোকের ক্রয়ক্ষমতা যে হ্রাস পাবে সেটাও হিসাবের মধ্যে রাখে না।

তবে যা-ই করুক শেষরক্ষা হওয়ার নয়। বিশ্বের সর্বত্র এখন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ ফুঁসে উঠছে। সব দেশেই নিজ নিজ উপায়ে মানুষ লড়ছে; লড়াইয়ের ধরনটা স্থানীয় কিন্তু লড়াইটা আন্তর্জাতিক। এটা না হয়ে উপায় নেই। কারণ পুঁজিবাদ একটা বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামও বিশ্বময় ঘটতে বাধ্য। পুঁজিবাদীরা আর এক থাকবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলে এখন আর কিছু নেই, ভেঙে পড়েছে; ইউরোপ ও আমেরিকা আলাদা হয়ে যাচ্ছে; ২০১৮ সালে জি-৭ সম্মেলন শেষ হয়েছে বড় পুঁজিপতি দেশগুলোর ঝগড়াঝাঁটির মধ্য দিয়ে; নব্য পুঁজিবাদী চীন তার বিপুল জনশক্তি ও নবীন উদ্দীপনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে  ড়তে চাইছে প্রতিযোগিতার বাজারে। পুঁজিবাদের পতনটা সব দিক থেকেই অনিবার্য।

বড় সত্য এটাই যে পুঁজিবাদীদের মুনাফা-উন্মত্ততা মানুষ, মানবতা ও প্রকৃতি—সব কিছুর সঙ্গেই শত্রুতা করছে, তার দাঁত ও নখ কোনো কিছুকেই রেহাই দিচ্ছে না। ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে ভৌগোলিক প্রকৃতির সব উপাদানই সে পণ্যে পরিণত করে ফেলেছে। যার দরুন কোনো কিছুই আর স্বাভাবিক থাকছে না, ক্ষতিগ্রস্ত ও বিকৃত হয়ে পড়ছে। ফলটা দাঁড়াচ্ছে এই যে পৃথিবী নামে এই গ্রহটির অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। মানুষ এখানে টিকতে পারবে কি না সেটাই একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু মানুষকে তো বাঁচতে হবে এবং তাকে মানুষের মতোই বাঁচতে হবে; বাঁচার তাগিদেই মানুষ পুঁজিবাদকে ভেঙে ফেলবে। মানুষের সভ্যতা অতীতে বহু রকমের সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, তবে বিশ্বব্যাপী অস্তিত্বের এমন সংকট আগে সে কখনো দেখেনি। কিন্তু এই সংকটও মানুষ অতিক্রম করবে বৈকি। মানুষের অসাধ্য কী?

সব মিলিয়ে যে বিষয়টা সামনে আসছে তা হলো মানুষের ইতিহাস থেমে যাবে না; পেছনে হটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, সে যাবে সামনে এগিয়ে। পুঁজিবাদ তাই শেষ কথা নয়। পুঁজিবাদের বিকল্প পুঁজিবাদ হবে এমনটা সম্ভব নয়, তাকে সংশোধন করে যে খাড়া করে রাখা যাবে এটাও হওয়ার নয়। দাসব্যবস্থা ভেঙে যেমন সামন্তব্যবস্থা এসেছে, সামন্তব্যবস্থা ভেঙে প্রতিষ্ঠা ঘটেছে পুঁজিবাদের, ঠিক তেমনিভাবে পুঁজিবাদকে হটিয়ে দিয়ে নতুন এক ব্যবস্থাকে আসতেই হবে। এই নতুন ব্যবস্থা হবে সমাজতান্ত্রিক। সমাজতান্ত্রিক না হয়ে উপায় নেই। কারণ হাজার হাজার বছর ধরে দাসব্যবস্থা, সামন্তব্যবস্থা ও পুঁজিবাদের ভেতর দিয়ে যে ব্যক্তিমালিকানার কর্তৃত্ব ছিল সেই মালিকানাকে অক্ষুণ্ন রেখে ইতিহাসের পক্ষে আর এগোবার উপায় নেই। ওই ব্যবস্থা ভেঙে যা আসবে সেটা সামাজিক মালিকানা ব্যবস্থা। সামাজিক মালিকানা ব্যবস্থায় মানুষের সৃষ্টিশীলতা অবারিত হবে, প্রাচুর্য দেখা দেবে বিশ্বজুড়ে, মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে উৎপাদনের ও প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা দূর হবে, অবসান ঘটবে অভাব ও সংঘাতের, যুদ্ধ পরিণত হবে অতীত ইতিহাসে; মানুষের উৎপাদিকা শক্তিকে পুঁজিবাদীরা উন্নতির যে স্তরে নিয়ে গেছে সেখান থেকে সে চলে যাবে উন্নততর এক স্তরে। থাকবে সৃষ্টিশীলতার বিপুল অবকাশ। প্রয়োজনের জগৎ থেকে মানুষ চলে যাবে স্বাধীনতার জগতে। এটা অনিবার্য। প্রশ্ন হলো কবে ঘটবে, কিভাবে ঘটবে এবং কেমন করে অবধারিতকে ত্বরান্বিত করা যাবে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061149597167969