গত সপ্তাহে উপকূলীয় বেশ ক’টি জেলা ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে লণ্ডভণ্ড ও ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। প্রায় প্রতি বছর এক-দুটি ভয়াল ঘূর্ণিঝড় আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। একেকটা ঘূর্ণিঝড়ের একেক নাম। নার্গিস, বুলবুল-এগুলো মানুষের নাম। ঘূর্ণিঝড়ের এসব নাম কী করে হয়? কে এসব নাম দেয়-কে জানে? এবারের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে ষোল-সতের জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জেএসসি ও জেডিসির শেষ ক’টি পরীক্ষা নিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবকদের কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। সকাল-বিকাল দু-তিন দফা রুটিন পরিবর্তন হবার কারণে কোন দিন কোন পরীক্ষা সেটি মনে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমার ছোট্ট মেয়ে তৃষা এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এ কয়দিন ওর রুটিনটা মুখস্ত রাখা আমার প্রধান কাজ ছিল। বিজ্ঞান ও গণিত বিষয় দুটোর পরীক্ষার তারিখ ও বার নিয়ে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। শেষ দুদিনের পরীক্ষা কোন দিন কোন বিষয়- সে নিয়ে বহু বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। একবার আগে বিজ্ঞান আরেকবার আগে গণিত, একবার পরে গণিত আরেকবার পরে বিজ্ঞান- বলে শিক্ষা বোর্ডগুলো চরম দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। শেষমেষ ‘আগে বিজ্ঞান, পরে গণিত’, ‘আগে বিজ্ঞান, পরে গণিত’ জপে জপে মুখস্ত রাখতে হয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভাবনার শিকার হতে হয়েছিল। যাক, তবু কোনোমতে জেএসসিটা শেষ হয়েছে। অনেক স্বজন মানুষ সন্তানের ভালো ফলের জন্য দোয়া করতে বলেছেন। আমার মেয়ে তৃষাসহ তাদের সন্তানদের জন্য পরম করুণাময়ের কাছে এই দোয়া করি-কেবল তাদের ভালো ফল নয়, তারা নিজেরাও যেন ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারে। আজকাল আমাদের চিন্তা-চেতনা এমন হয়েছে- সন্তান যাই হউক তার পরীক্ষার ফল যেন ভালো হয়। ভালো মানুষ না হলে ভালো ফল দিয়ে কী হবে?- এ কথা নিয়ে কোনো ভাবনা চিন্তা নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় মনটা খুব বিচলিত। এ দু-তিন বছর থেকে ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনা সবার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে রেলের এমনিতে দুর্ণাম। মানুষ পারত পক্ষে রেলে চড়তে চায় না। আমার আবার রেলে চড়ার খুব শখ। যখন ঢাকা, চিটাগাং কিংবা কুমিল্লা যাই, ট্রেনে যাবার ধান্ধা করি। আরামে ট্রেনের ভেতর ঘুরেফিরে কিংবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া যায়। চা-নাস্তা এমনকি ভাতের ব্যবস্থা থাকে। টয়লেটের সুবিধা পাওয়া যায়। সড়ক পথে অন্য কোনো বাহনে এগুলো থাকে না। এরপরও অনেকে রেলে চড়তে চান না। এর প্রধান কারণ, রেলের সময়সূচি ঠিক থাকে না। অনেক সময় দেরি করে ছাড়ে এবং দেরিতে পৌঁছে বলে রেলের সাথে একটি প্রবাদ জুড়ে আছে। সেটি এই- ‘নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে’? প্রবাদটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকে এটি শুনে আসছি। আমাদের অনেকের ব্যক্তি জীবনেও এটি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। সময়মতো কাজ করার প্রতি আমাদের মতো অবহেলা দুনিয়ার আর কোথাও চোখে পড়ে না।
আমার একমাত্র ছেলে তুহিন ইংল্যাণ্ডের বার্মিংহাম শহরে থাকে। প্রতিদিন একই সময়ে সকাল ন’টায় মাকে ফোন দেয়। এই সময়ের কোনো হেরফের নেই। এসময় মা সব কাজ-কাম ফেলে রেখে ফোনের অপেক্ষায় বসে থাকেন। উন্নত দেশগুলোর প্রতিটি কাজ একেবারে কাঁটায় কাঁটায় সময় মেপে। আমরা এমন হতে পারি না কেন? ছেলের মুখে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মেট্রো রেল ও পাতাল রেলের কথা শুনে বিস্মিত হই। আমাদের দেশেও মেট্রো রেল চালু হবার কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। আমাদের মেট্রো রেল যেন তাদের মতো হয়। আমরা যেন রেলের দুর্ণাম কাটিয়ে উঠতে পারি-সে চেষ্টা সবার করা উচিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় রেল দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত সবার জন্য নিরন্তর সমবেদনা। তাদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয় স্বজন যেন শোক সহ্য করে কঠিন এই সময়টি পার করতে পারেন-পরম করুণাময় মহান মা’বুদের দরবারে এই ফরিয়াদটি জানাই।
দেশে পেঁয়াজের যা দাম তাতে সাধারণ মানুষের পেঁয়াজ কিনে খাওয়া এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আপেলের চেয়ে এখন পেয়াজের দাম বেশি। আপেল একশ টাকা আর পেয়াজ দুশো টাকা। ধনী-গরীব নির্বিশেষে নাভিশ্বাস উঠার উপক্রম। প্রতি বছর এ সময় পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়ে বটে। কিন্তু এবার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা সিণ্ডিকেট বানিয়ে দেশে কৃত্রিম পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টি করছে কিনা-সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। তা না হলে সরকারের বদনাম কেবল বাড়তেই থাকবে।
জেএসসি পরীক্ষা সবেমাত্র গতকাল শেষ হয়েছে। জেডিসির মনে হয় আরও দু-একদিন বাকি। আরও দুদিন পর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শুরু হবে। এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষাও শেষ। সব স্কুল ফল দিয়ে দিয়েছে। বোর্ডের কথা মতো ফল দেয়া কঠিন। এক বিষয়ে ফেল করলেও মূল পরীক্ষায় দেয়া যাবে না-এ কথাটি কয়টি স্কুল মানতে পেরেছে? খেয়েদেয়ে কাম-কাজ নেই। আজেবাজে সার্কুলার? বিবেচনা ও বিশেষ বিবেচনায় সারা জীবন এক-দু বিষয়ে অকৃতকার্যদের ফাইনাল পরীক্ষায় দিতে দেখলাম। আর এখন? নির্বাচনী পরীক্ষায় পাঁচ-সাত বিষয়ে ফেল করা ছাত্রও মূল পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে যায়। এর পেছনে বোর্ডের ইঙ্গিত থাকে। তাহলে এমন সার্কুলারের মানেটা কী?
একটা বিষয় নিশ্চয় সবাই লক্ষ করেছেন। নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাস শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। এ দুই মাস তেমন লেখাপড়া নেই। বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে এমনিতে হেলাফেলা থাকে। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এসএসসি পরীক্ষা। রমজানে এক মাসের ওপরে বন্ধ। গ্রীষ্মের ছুটি, শীতের ছুটি আর পূজো-পার্বনের ছুটি মিলে সারা বছর ছুটি আর ছুটি। তার ওপর জাতীয় দিবস তো রয়েছেই। সব মিলে লেখাপড়ার জন্য কয়দিন স্কুল খোলা থাকে? এ বিষয়গুলো ভেবে দেখা দরকার।
আমাদের শিক্ষা অতিমাত্রায় পরীক্ষা নির্ভর হয়ে পড়েছে। পড়ালেখা আজকাল মনে হয় কেবল পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার জন্য লেখাপড়া নয়, লেখাপড়ার জন্য পরীক্ষা-সে কথাটি আমরা ভুলে যেতে বসেছি। এ কারণে আমাদের লেখাপড়ার মানে আজ এত অধঃগতি। কী শেখা হলো না হলো সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়া। জিপিএ ফাইভ না পেলে কোনো মা-বাবাই সন্তানের উপর খুশি নয়। জিপিএ ফাইভ যদি সন্তানের ভেতর মানবিকতা ও নৈতিকতা জন্ম দিতে না পারে, তবে সেটি দিয়ে কী হবে? বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে যারা হত্যা করেছে তারা সবাই প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিভিএ ফাইভ পেয়েছিল। একেকজনের চার-পাঁচটে জিপিএ ফাইভ। এসব জিপিএ ফাইভ তাদের কোনো কাজে লাগেনি। তা পেয়েও তারা অমানুষ হয়েছে। এমন জিপিএ ফাইভের কোনো দরকার নেই। তাদের মা-বাবাদের সন্তানের জিপিএ ফাইভের আনন্দ আজ কোথায়? আবরারের হত্যাকারী তার সতীর্থদের জিপিএ ফাইভগুলো আজ কোথায় হারিয়ে গেল? এ জাতীয় জিপিএ ফাইভ আমাদের শিক্ষার জন্য কলঙ্ক বৈ কিছু নয়।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।