নীলফামারীর ডোমারে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেছে মেধাবী ছাত্র সুমন চন্দ্র রায় (১৬)। কিন্তু জিপিএ-৫ পেয়েও মুখে হাসি নেই তার। কারণ, অর্থাভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সুমনের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ।
পরীক্ষার ফল পেয়ে সবাই যখন মিষ্টি বিতরণে ব্যস্ত, তখন ভালো ফল করার পরও মুখে হাসি নেই তার পরিবারের। উপজেলার মটুকপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসিতে ৯১৭ মার্কস পেয়ে জিপিএ-৫ লাভ করেছে সুমন চন্দ্র রায়। উপজেলার তিনজন পরীক্ষার্থী মানবিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। সুমন তাদের মধ্যে অন্যতম।
সুমন উপজেলার বোড়াগাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব বোড়াগাড়ী ঘাটপাড়া গ্রামের কার্তিক বর্মনের ছেলে। তার মা সন্ধ্যা রানী মানুষের ক্ষেতে কাজ করে, বাবা বোড়াগাড়ী বাজারে একটি সার ও কীটনাশকের দোকানে কাজ করে সংসার চালায়। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সুমন দ্বিতীয়।
সুমন লেখাপড়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে তার বাবাকে কাজে সহযোগিতা করেন। তার বড়ভাই ডোমার সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র, ছোটবোন একই স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। স্বল্প আয়ের দরিদ্র এই পরিবারের পক্ষে সংসার খরচ চালিয়ে সুমনের লেখাপড়ার খরচ বহন করা সম্ভব নয়।
সুমন জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। ভবিষ্যতে লেখাপড়া করে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে বাবা-মা আর শিক্ষকদের মুখ উজ্জ্বল করতে চাইলেও বর্তমানে তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। জিপিএ-৫ পেয়েও তার পরিবার আর তাকে লেখাপড়া করাতে পারছে না। ফলে মাঝ পথেই থেমে যাচ্ছে তার ভবিষ্যৎ। হয়ত লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাবার সাথে অন্যের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে সে, হয়ত উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে না পেরে শিক্ষাজীবন এখানেই শেষ হয়ে যাবে সুমনের।
সুমনের বাবা কার্তিক বর্মন জানান, ছেলে জিপিএ-৫ পেয়ে তার মুখ উজ্জ্বল করলেও তার পক্ষে আর সুমনকে লেখাপড়া করানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমি মানুষের দোকানে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাই। স্কুলে তার শিক্ষকরা সহযোগিতা করেছিল বলে তাকে লেখাপড়া করানো সম্ভব হয়েছিল। পরীক্ষার ফরম পূরণ স্কুল বিনা পয়সায় করে দিয়েছিল। তাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
বর্তমানে আমার পক্ষে আর কোনোভাবেই তাকে লেখাপড়া করানো সম্ভব হচ্ছে না বলেই তিনি কেঁদে ফেলেন। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমারও খুব ইচ্ছে ছিল আমার ছেলে বড় হয়ে বড় চাকরি করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। তবে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় ছিল তার অপরাধ।
মটুকপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক বদরুজ্জামান মেডেল বলেন, লেখাপড়ায় সুমন খুবই মেধাবী। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে তাকে দেখছি। মেধার কোনো কমতি না থাকলেও দারিদ্র্যের কারণে হয়ত আর তাকে পড়াতে পারবে না তার পরিবার।
সুমন বলেন, স্কুলের শিক্ষক আখতারুজ্জামান লিটন স্যারের কাছে আমি পড়তাম। তিনি বিনা বেতনে আমাকে পড়াতেন। আমার এতদূর আসার পিছনে তার অবদান অপরিসীম।
শিক্ষক রায়হানুল করিম বাবু জানান, স্কুলে শান্ত স্বভাবের সুমন লেখাপড়ায় অদম্য। তার ইচ্ছে ছিল সে বিজ্ঞান বিভাগে পড়বে। কিন্তু দারিদ্র্যতার কারণে তার সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিলে সে আরও ভালো ফল করতো।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইসমত আরা জানান, স্কুলে তাকে কোনো বেতন দিতে হতো না। ফরম পূরণও স্কুল থেকে করানো হয়েছে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা বিত্তবান ব্যক্তি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তবে হয়ত তার লেখাপড়া চালানো সম্ভব হবে, ভবিষ্যতে ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।