জেএসসির মানবণ্টন ও ইংরেজি বিষয়ে কিছু কথা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এক সময় ইংরেজ জাতি গোটা দুনিয়া শাসন করেছে। তাদের সাম্রাজ্যে নাকি সূর্য অস্ত যেত না। আজ তাদের সে সাম্রাজ্য নেই বটে, কিন্তু তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি দিয়ে তারা আজো যে গোটা পৃথিবী দখল করে রেখেছে তা অস্বীকার করার জো নেই। পৃথিবীর আর সব দেশের স্বাধীনতা দিবস থাকলেও খুব সম্ভব ইংরেজদের কোন স্বাধীনতা দিবস নেই। কেননা, কেউ তাদের কোনদিন পরাহত করেনি বলে তাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়নি। তাই জাতি হিসেবে ওদের স্বকীয়তা ভিন্ন ও আলাদা।

তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি আজ সারা দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে পরিচিত। এ ভাষার সাথে তাল দিয়ে চলার মত আরেকটি ভাষা কোথাও নেই । পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে বলে আমার জানা নেই যেখানে ইংরেজি ভাষা কম বেশি চলে না। গোটা দুনিয়া জুড়ে কোন দেশে ইংরেজি 'ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ' আবার কোন দেশে 'সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ'। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন-আদালত তো এখনো ইংরেজিতেই চলে। তাই আগের ইংরেজ জাতির ভৌগোলিক সাম্রাজ্যের মত এখন ও তাদের ভাষা তথা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যে সুর্য অস্ত যাবার সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গটা এ কারণে যে, গত ক'দিন ধরে জেএসসি পরীক্ষার মানবণ্টন ও প্রশ্ন কাঠামো নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছিল। বিষয় কমানো, নম্বর কমানো, এমসিকিউ বাদ দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেষ বিষয় কমিয়ে নম্বর কমানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অন্যের কাছ থেকে এর প্রতিক্রিয়া না জেনেও নিজের প্রতিক্রিয়াটুকু ব্যক্ত করবার জন্যে আজকের এ লেখা।

আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি দু'টো পরীক্ষারই বিপক্ষে। আমরাতো এ দু'টো পরীক্ষা না দিয়েই লেখাপড়া করেছি। কিছু ভাল দিক থাকলেও এ দু'টো পরীক্ষায় মন্দের ভাগই বেশি বলে অনেকের মত আমারও বিশ্বাস। এ কারণে তৃণমুল পর্যায় পর্যন্ত নোট-গাইড ও কোচিং বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। প্রশ্নফাঁস অপ্রতিরোধ্য হয়েছে। শিশু-কিশোর মনে বই ভীতি বেড়েছে। লেখাপড়া জ্ঞান নির্ভর না হয়ে পরীক্ষা নির্ভর হয়ে উঠেছে। আরও কতো কী?

যাক সে কথা। আমার কথা আরেক জায়গায়। সেটি হলো- জেএসসি পরীক্ষায় নতুন মানবণ্টনে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে ৫০ করে মোট ১০০ নম্বর কমিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে। বিষয়টি আমার কাছে তেমন একটা ভাল কাজ মনে হয়নি।  বরং একটি মন্দ কাজ বলেই মনে হয়েছে। যে কারণে তাই মনে হয়, সেটা বলি।

বর্তমানে গ্লোবালাইজেশনের যুগ। গ্লোবাল পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষার একক আধিপত্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি বলতে যা বোঝায়, সবই এ ভাষার আয়ত্তে। এ ভাষাকে অবহেলা কিংবা পরিহার করে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করা কঠিন।

সে নব্বইর দশকে আমাদের দেশে ডিগ্রি ক্লাসে ইংরেজি বিষয়টি আবশ্যিকের পরিবর্তে ঐচ্ছিক করার ফল আমরা কী পেয়েছি? আজকাল বিএ- এমএ পাস করা অনেকে দু'চার লাইন ইংরেজি শুদ্ধ করে লিখতে পারে না। কথা বলা তো দূরের কথা। 

বড় লোকের ছেলে মেয়েরা ঠিকই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করে। তারা টোফেল, আইফেল, আইইএলটিএস আরো কত কিছু পড়ে ইংরেজি রপ্ত করে। উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। 'এ' লেভেল- 'ও' লেভেল সম্পন্ন করে ইংরেজিতে পারদর্শী হয়। আর সাধারণ ঘরের সন্তানেরা যারা ইংলিশ মিডিয়াম কিংবা 'এ 'লেভেল- 'ও ' লেভেল ইত্যাদি পড়ার সুযোগ পায় না তাদের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ সীমিত করার মানেটা কী ?

কেউ হয়তো বলতে পারেন, আমি ইংরেজি প্রীতি  দেখাচ্ছি। তা কিন্তু নয়। যা বাস্তব তাতো স্বীকার করতেই হয়। মেনে ও নেয়া লাগে । স্বদেশ কিংবা বিদেশে যে ভাল ইংলিশ জানে তার সমাদর বেশি। চাকরি-বাকরিতে অগ্রাধিকার।

আর আমাদের মাতৃভাষা বাংলার কথা তো ভিন্ন প্রেক্ষাপটেই অত্যধিক তাৎপর্যপুর্ণ। যে তার মাতৃভাষাকে ভাল করে আয়ত্ব করতে পারে না কিংবা পারার সুযোগ পায় না তার কাছে আশা করার কিছু থাকে না। মাতৃভাষা দিয়েই তো তাকে দুনিয়ার সব কিছু অর্জন করতে হয়। এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে বাংলা বিষয়ে নৈর্ব্যক্তিক মার্কা প্রশ্নের কারণে ছেলে-মেয়েরা ব্যাকরণ অংশের ধার ধারে না। এ বিষয়ের অনেক শিক্ষক ও কেবল ভাব সম্প্রসারণ, সারাংশ-সারমর্ম, চিঠি-দরখাস্ত আর রচনা পড়িয়ে দায় সারেন। তাই আজকাল অনেকে  বিএ-এমএ পাস করে মাতৃভাষায় ভাল করে একটা বক্তৃতা যেমন দিতে পারে না তেমনি নিজে থেকে নতুন কোন পরিস্থিতিতে  একটা চিঠি কিংবা দরখাস্তও লিখে দিতে পারে না। আমাদের শিক্ষায় এ দৈন্য সত্যি সত্যি লজ্জার বিষয়।

আর হবে নাই বা কেন?  যখন-তখন আমাদের সিলেবাস ও কারিকুলাম বদল হয়। প্রশ্নের ধরণ, মানবণ্টন, বিষয় কমানো-বাড়ানো ইত্যাদি বিষয় পরীক্ষার মাত্র দু'চার মাস আগে করা হয়। শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি কিংবা শেষাংশে এসে এসব করলে কেবল শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকেরা পর্যন্ত বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। আমাদের দেশে প্রায়শই এ কাজটি এভাবেই করা হয়ে থাকে। চলতি শিক্ষাবর্ষের জেএসসি পরীক্ষার মাত্র পাঁচ মাস আগে মানবণ্টন ও প্রশ্নের রুপরেখা নতুন করে প্রণয়ন করায় নিঃসন্দেহে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কেই বিপাকের সম্মুখীন হতে হবে। সময়মত এ সব করতে সমস্যা কোথায় তা ভেবে পাই না। 

পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্নের কাঠামো, মানবণ্টন ইত্যাদির পরিবর্তন এবং বিষয় কমানো-বাড়ানো কতোই তো দেখলাম। সবই অসময়ে ও মাঝ পথে করা হয়। এতে লাভ কিছু তো হয় না, বরং ক্ষতি সাধিত হয়।  জেএসসি কিংবা অন্য যে কোন পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয় পরিবর্তন যথাসময়ে হওয়া অপরিহার্য। শিক্ষার সকল স্তরে মাতৃভাষা বাংলা এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার সুযোগ সীমিত না করে আরো অবারিত করা প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের শিক্ষার দৈন্যদশা ঘোচানো বড়ই কঠিন কাজ হবে ।

 

লেখক  :  অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0061049461364746