জ্ঞান, মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তাচেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বর্তমান বিশ্বের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল হাতিয়ার। আধুনিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। আর তাই তো একবিংশ শতাব্দীর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ দুই-ই আবর্তিত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিকে ঘিরে। তথ্যপ্রযুক্তিই আগামী দিনে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে এবং শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে। শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমানে সারা বিশ্বব্যাপী। বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। শিক্ষা উপকরণ ডিজিটালাইজেশন ও তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন শিক্ষার মানোন্নয়নে যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করছে। আর শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেই এ ডিজিটালাইজেশনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা উচিত।
প্রাথমিক শিক্ষার ডিজিটালাইজেশনের দুইটি দিক রয়েছে :
১। প্রাথমিক শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া তথা ডিজিটাল ক্লাসরুমে এর ব্যবহার।
২। প্রাথমিক শিক্ষা কনটেন্ট ইন্টারঅ্যাক্টিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল ভার্শনে রূপান্তরকরণ।
প্রাথমিক শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া তথা ডিজিটাল ক্লাসরুমের ব্যবহার—
উদ্দেশ্য : বিশ্বায়নের যুগে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও শিক্ষার গুণমান নিশ্চিতকরণে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো এবং শ্রেণি কার্যক্রমে অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের মতো প্রযুক্তিকেও একটি শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করবে।
কর্মপদ্ধতি : কম্পিউটার শিক্ষা বা ল্যাবভিত্তিক বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে তথ্যপ্রযুক্তিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে কাজে লাগানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার বা অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্ল্যাকবোর্ডের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে ব্যবহূত একটি আধুনিক শিক্ষা উপকরণ হিসেবে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে সরকারের তরফ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ব্যবহূত বিভিন্ন উপকরণের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম ও স্পিকারের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। এ শ্রেণিকক্ষকেই বলা হচ্ছে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’।
প্রয়োজনীয়তা : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা লাভ এবং তা আয়ত্ত ও প্রয়োগ করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) সবার জন্য টেকসই গুণমানসম্পন্ন শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলা অতি জরুরি। মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে বিকশিত চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং অনুসন্ধিত্সু মননের অধিকারী হয়ে সব শিক্ষার্থী যাতে প্রতি স্তরে মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল শিক্ষা কনটেন্টের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনা ও সৃজনশীলতার উজ্জীবন এবং তার জীবনঘনিষ্ঠ জ্ঞান বিকাশে সহায়ক।
প্রাথমিক শিক্ষা কনটেন্ট ইন্টারঅ্যাক্টিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল ভার্শনে রূপান্তরকরণ—
উদ্দেশ্য :জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের (প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি) আলোকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ক (১৭টি বইয়ের) ইন্টারঅ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল শিক্ষা কনটেন্ট তৈরি করা এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য।
কর্মপদ্ধতি : পাঠ্যপুস্তকের ধারণাসমূহ আরো আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ছবি, চার্ট, ডায়াগ্রাম, অডিও, ভিডিওসহ মাল্টিমিডিয়া উপকরণসমূহ সংযোজন করে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়ভিক্তিক শিক্ষক, প্রশিক্ষক, প্যাডাগোজি বিশেষজ্ঞ, এডুকেশন সেক্টর বিশেষজ্ঞ, চাইল্ড সাইকোলজিস্ট, কালার, প্রোগ্রামিং ও অ্যানিমেশন বিশেষজ্ঞদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে প্রতিটি অধ্যায়ের কাঙ্ক্ষিত শিখনফলের আলোকে এই ডিজিটাল শিক্ষা কনটেন্টসমূহ প্রস্তুত করা হচ্ছে।
প্রয়োজনীয়তা : কনটেন্টসমূহ শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠ্যবিষয়কে সহজ এবং শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে অংশগ্রহণমূলক, আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক করে তোলা। কনটেন্টসমূহ শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শ্রেণিকক্ষে পরিণত করা। পাঠদানকে অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করা এবং বিষয়ভিত্তিক ধারণা স্পষ্ট করা ও উন্নততর প্রয়োগ। পাঠ্য সম্পর্কে শিক্ষকের অনুধাবন বৃদ্ধি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য স্ব-শিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পরিচিত করানো।
যেহেতু জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-২০৩০-এর লক্ষ্যমাত্রা-০৪ এ টেকসই, গুণমানসম্পন্ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে; সেহেতু জেলা প্রশাসন, খুলনার উদ্যোগে ইতিমধ্যেই উপর্যুক্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অচল ল্যাপটপসমূহ ও ডিজিটাল ক্লাসরুমের উপকরণাদি পুরোপুরি সক্রিয় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যার্থে বরাদ্দকৃত অর্থ (টিআর, এডিপি প্রভৃতির বরাদ্দ) থেকে সকল স্কুলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাপটপ ও ডিজিটাল ক্লাসরুম উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড আর উন্নয়নের শিখরে আরোহণের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর করার কোনো বিকল্প নেই। আর শিক্ষাব্যবস্থার ডিজিলাইজেশনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায়, কেননা একটি জাতির মূল ভিত্তিই রচিত হয় শিশুদের প্রদত্ত শিক্ষা কার্যক্রমের ভিত্তিতে। আর এ কারণেই উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষার ডিজিটালাইজেশনে যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এরই আলোকে জেলা প্রশাসন, খুলনার উদ্যোগে শতভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাসরুম ও ডিজিটাল কনটেন্ট সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ইনোভেটিভ কার্যক্রমও গ্রহণ করা হচ্ছে। আশা করা যায়, ২০১৯ সালের মধ্যেই শতভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।
লেখক : মোহাম্মদ হেলাল হোসেন, জেলা প্রশাসক, খুলনা