ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস

সৌমিত্র শেখর |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হলো ১৫ অক্টোবর। ১৯৮৫ সালের এই দিন জগন্নাথ হলের ছাদধসে অনেক ছাত্র-কর্মচারী-অতিথি নিহত হয়েছিল। তাই অক্টোবর মাস এলেই দেবব্রত, মুকেশ বা সমীর কান্তিদের মনটা সত্যি চঞ্চল হয়ে ওঠে। বিচলিত হয়ে পড়ে তাঁদের মতো আরো অনেকের হৃদয়। এঁরা আজ বিভিন্ন পেশায়, নানা স্থানে। জীবনযাপনের প্রয়োজনে পরস্পর থেকে দূরে; বিচ্ছিন্নও। কিন্তু অক্টোবর মাস সবাইকে গেঁথে দেয় কোনো এক অদৃশ্য সুতায়, মমতার অদেখা রাখিতে। কারণ ১৯৮৫ সালের মধ্য অক্টোবরে তাঁরা একই সঙ্গে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। আর তাই অক্টোবরের ওই নির্দিষ্ট তারিখে যে যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁরা প্রলম্বিত করেন নিজেদের হাত; হাতগুলো পৌঁছে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আঙিনায়, যেখানে থরে থরে সাজানো ছিল লাশ। যেখানে ধসে পড়েছিল একটি ভবন এবং সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠেছিল গগনবিদারী আহাজারি। দিনটি ১৫ অক্টোবর, ১৯৮৫। পরে যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এলাকায় আজ যেখানে ‘অক্টোবর স্মৃতিভবন’ দাঁড়িয়ে আছে, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে ছিল অন্য একটি স্থাপনা। একে বলা হতো ‘পরিষদ ভবন’। এই নাম বলার কারণ, এটাই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ ভবন অর্থাৎ আজকের সংসদ ভবন। ১৯৪৭ সাল থেকে এখানেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসত। একে ‘অ্যাসেম্বলি হল’ও বলা হতো। ১৯৮৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এই ভবনেই সংসদ সদস্যদের চেয়ার নিক্ষেপে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী নিহত হন। নতুন প্রাদেশিক ভবন নির্মিত হলে ১৯৬৩ সালে এই ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাত্রদের আবাসিক প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ হলের সঙ্গে যুক্ত করেন। এই ভবনটি ছিল ব্রিটিশ আমলের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ প্রায় দেড় শ বছর আগে নির্মিত। এর নির্মাণে ছিল  চুন ও সুরকির গাঁথুনি আর লোহার রডের বিম।

১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার। তখন চিত্তবিনোদনের জন্য টিভি চ্যানেল হিসেবে বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশনই ছিল একমাত্র অবলম্বন। প্রতি মঙ্গলবারের মতো সেদিনও ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক ‘শুকতারা’। সেনা শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অগণতান্ত্রিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তখন বেগবান। ছাত্ররা প্রতিবাদে উত্তপ্ত করে রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তখন ‘অ্যাসেম্বলি হল’ ছাত্রদের মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য তত দিনে ‘অ্যাসেম্বলি হল’ একাত্তরে শহীদ আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই ‘অনুদ্বৈপায়ন ভবনে’ ১৯৭৯ সালে টেলিভিশন সেট স্থাপন করা হয়েছিল। সেই টেলিভিশনে রাত সাড়ে ৮টায় আরম্ভ হয় নাটক। এ সময় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপজনিত কারণে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা হাওয়া বয়ে যায় ও প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয়।

এর মধ্যেই দু-চারজন করে প্রায় চার শ ছাত্র এলে টেলিভিশন কক্ষ ভরে ওঠে। ঠিক তখনই—তখন রাত পৌনে ৯টা, অকস্মাৎ ভবনটির ছাদ ধসে পড়ে। যারা ভেতরে জায়গা না পেয়ে দরজা বা জানালার ধারে বসে নাটক দেখছিল, তারা দৌড়ে বের হতে পারলেও অধিকাংশ ছাত্রই সেদিন ছাদচাপা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং চাপা পড়া ছাত্রদের আর্তচিৎকারে জগন্নাথ হলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই হলের অন্যান্য ভবনের ছাত্র এবং খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ আর্তদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। একে তো টিপটিপ বৃষ্টি, অন্যদিকে বিদ্যুত্হীন অবস্থা—এই প্রতিকূল পরিবেশে সারা রাত উদ্ধারকাজ তেমন এগোতে পারেনি। উদ্ধারকৃতদের এক হাসপাতালে স্থান দেওয়া সম্ভব না হলে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পিজি, সোহরাওয়ার্দী, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, পঙ্গু ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যক্তি-মালিকানাধীন ক্লিনিকেও ভর্তি হয় বহু আহত ছাত্র। মাইকে তখন রক্তদান করার জন্য করুণ আকুতি ঘোষিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং বহু সাধারণ মানুষ এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাসপাতালে চলে যায় রক্ত দিতে। রক্তদান করার আগ্রহীদের এত ভিড় স্মরণকালে আর দেখা যায়নি। তার পরও সব জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। নিহতদের লাশ শহীদ মিনারের পাদদেশে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়। পরের দিন দেশের সংবাদপত্রগুলোর প্রধান খবর ছিল এটাই।

দৈনিক সংবাদ শিরোনাম দেয় : ‘জগন্নাথ হল মিলনায়তন ধসে ৫০ জন ছাত্র নিহত, আহত দুই শতাধিক। রক্তদানের আবেদন।’ বাংলার বাণী সংবাদ ছাপে এই শিরোনামে : ‘জগন্নাথ হলের ছাদধসে ৫০ জন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু আহত ৩ শতাধিক।’ কোনো পত্রিকা একে লেখে ‘জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি’ বলেও। তখনো আহত ও নিহতের সঠিক হিসাব না পাওয়ায় সংবাদ শিরোনামে ভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয়। পরে দেখা গেছে, মোট ৩৯ জন নিহত হয়েছে এবং আহতের সংখ্যা শতাধিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছে চিরতরে। এই দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় পনেরো ও সাতদলীয় ঐক্য জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা। বিদেশি কূটনীতকরাও শোক জ্ঞাপন করেন। তিন দিন জাতীয় শোক ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে ১৬ অক্টোবর সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের আত্মীয়দের প্রতি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। সে বছর থেকেই ১৫ অক্টোবরকে ঘোষণা করা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস’ হিসেবে।

এই দুর্ঘটনার কয়েক দিন পর অর্থাৎ ১৯ অক্টোবর থেকে দুর্গাপূজা (ষষ্ঠী) আরম্ভ হয়। জগন্নাথ হলের এই শোকাবহ ঘটনায় সারা দেশে অনাড়ম্বরে পূজা অনুষ্ঠান করে ব্যানারে লেখা হয় ‘কাঁদো দেশবাসী কাঁদো’। যে মায়ের সন্তান নিহত বা আহত হলো মাত্র কয়েক দিন আগে, তাঁর কাছে পূজার আনন্দ কান্নার জলেই তো ভেসে যাবে। গিয়েছেও তাই। দুর্ঘটনার পর সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা এক সাংবাদিক পরের দিন পত্রিকায় লেখেন : ‘ভিড় ঠেলে কোনো রকমে ঢুকলাম হলের ভেতরে। আহাজারি-রোনাজারি আর আর্তচিৎকার করছে প্রতিটি মানুষ। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছে, তাপসকে দেখেছিস, কেউ বলছে প্রতাপকে দেখেছিস? কেউ হয়তো কথার জবাব দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না।

পর পর একটি একটি অচেতন দেহকে কয়েকজনে মাথায় করে বের করে নিয়ে আসছেন ভেতর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠিয়ে দেওা হচ্ছে’। (বাংলার বাণী, ১৬.১০.১৯৮৫) নিহত-আহতের সংখ্যা ঘটনা সংঘটনের সময়ই অনুমান করা যায়নি। তাই পরদিনের সংবাদপত্রে এই সংখ্যা নিয়ে পার্থক্য দেখা যাবে। পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে নিহতদের নাম, পরিচয় পাওয়া গেছে প্রায় সব আহতের। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবরের দুর্ঘটনা তৎকালীন কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীনতার জন্যই ঘটেছে বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ড. রঙ্গলাল সেন লিখেছেন : ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এক দশককাল যখনই যিনি হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন, তিনিই অ্যাসেম্বলি ভবনের ছাদ মেরামত করার জন্য বহু চিঠি লিখেছেন, যার সংখ্যা অর্ধশতাধিক হবে।’

বলা বাহুল্য, এসব চিঠির বক্তব্যকে যথাসময়ে গুরুত্ব দিলে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও বলা প্রয়োজন, প্রাধ্যক্ষগণও শুধু চিঠি লিখেই দায়িত্ব ‘শেষ’ বলে মনে করেছেন। ভবন সংস্কার করা যদি তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকত, তাহলে এর পেছনে তাঁদের ‘লেগে থাকা’ জরুরি ছিল। সেটা তারা করেননি। ফলে এই দুর্ঘটনার জন্য তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে হল-প্রশাসন, বিশেষ করে প্রাধ্যক্ষের উদাসীনতাকেও দায়ী করা যায়। অক্টোবর দুর্ঘটনার পর এতদসংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে গৃহীত নানা সিদ্ধান্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয়েছে; কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়নি। অক্টোবর দুর্ঘটনার পর জগন্নাথ হলে ‘অক্টোবর স্মৃতিভবন’ নামে একটি নতুন ছাত্রাবাস ভবন নির্মিত হয়। এর মধ্যে বাস করে জগন্নাথ হলের মেধাবী, শান্ত ও সৌম্যদর্শন ছাত্ররা তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। আমরা আর অক্টোবর দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে চাই না বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সর্বত্র এ ধরনের ভবন সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

 

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059850215911865