ঢাবিতে গেস্টরুম মানেই নির্যাতন কেন্দ্র

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) নবীন শিক্ষার্থীরা আসেন একরাশ স্বপ্ন নিয়ে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন বলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সংযুক্ত হলে উঠতে হয়। তবে তা হল প্রশাসনের মাধ্যমে নয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় গণরুমে তাদের স্থান হয়। এই 'দয়া'র বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। কোনো কারণে কর্মসূচিতে যেতে না পারলে কিংবা বড় ভাইদের সালাম দিতে ভুল হলে তাদের ওপর নেমে আসে 'গেস্টরুম' নামক অকথ্য নির্যাতন। গত সাত বছরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ১৩টি আবাসিক হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ৫৮টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের কাউকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে; কাউকে আবার পিটিয়ে হল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সিট দখল করা হয়েছে। আধিপত্য বিস্তারে নিজ সংগঠনের পদধারী নেতাকেও 'ছাত্রদল' ও 'শিবির' ট্যাগ দিয়ে পিটিয়ে হলছাড়া করার নজিরও রয়েছে। বুধবার (১৬ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মাজহারুল ইসলাম রবিন।

গেস্টরুমগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের আত্মীয়স্বজন ও দর্শনার্থীদের জন্য। তবে ঢাবির গেস্টরুম আলাদা। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে গেস্টরুম একটি আতঙ্কের নাম। এখানে প্রতি রাতেই হলের নবীন শিক্ষার্থীদের হাজিরা দিতে হয়। সিনিয়রদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় সারাদিনের কাজের। ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিঙে না যাওয়া, নেতাদের সালাম না দেওয়া এবং তাদের আদেশ মান্য না করলেই নেমে আসে চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এ ছাড়া ছাত্রদল-শিবির সন্দেহে প্রায়ই মারধর করার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

তথাকথিত ম্যানার শেখানোর নামে হলের প্রতিটি গেস্টরুমই রূপান্তরিত হয়েছে একেকটি 'টর্চার সেলে'। ঢাবির ১৩টি ছাত্র হলের অর্ধশত কক্ষ ব্যবহূত হয় 'টর্চার সেল' হিসেবে। কখনও শয়ন কক্ষ, আহার কক্ষ, অতিথি কক্ষ, হলের ছাদ, মাঠ কিংবা গণরুমগুলো 'টর্চার সেল' হয়ে ওঠে। এসব টর্চার সেলে লাঠি, হকিস্টিক, গ্যাস পাইপ, ক্রিকেট স্টাম্প, লোহার রড দিয়ে চালানো হয় নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে হল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী।

ছেলেদের হলের তুলনায় কম হলেও মেয়েদের হলেও আছে এমন নির্যাতনের ঘটনা। কেবল ছাত্রলীগই নয়, অতীতে অন্যান্য ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনও সিট দখলের রাজনীতির সুযোগে শিক্ষার্থীদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন করেছে।

সাধারণত গেস্টরুম দুই ধরনের- একটি ফরমাল, অন্যটি মিনি গেস্টরুম। সপ্তাহে তিন দিন ফরমাল, তিন দিন মিনি গেস্টরুম করানো হয়। একদিন দেওয়া হয় ছুটি। হলগুলোতে রাত ১০টার পর গেস্টরুম শুরু হয়ে ১২টা পর্যন্ত চলে। এরপর রাত ৪টা পর্যন্ত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলের বাইরে থাকতে বাধ্য করা হয়। ফরমাল গেস্টরুমে প্রথমে হলের নবীন শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করেন, এরপর আসেন তাদের ইমিডিয়েট সিনিয়ররা। তারা নবীনদের সারা দিনের কর্মকাণ্ডের হিসাব নেন। সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এরপর পালাক্রমে আসতে থাকেন হলের সিনিয়র নেতারা। সর্বশেষ আসেন হল শাখার সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক। তিনি পরবর্তী দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করেন। এরপর শেষ হয় ওই দিনের গেস্টরুম।

অন্যদিকে হলের যে রুমে রাজনৈতিক কর্মীরা থাকেন, সেখানে অনুষ্ঠিত হয় মিনি গেস্টরুম। সেই কক্ষের মেঝেতে বসানো হয় নবীন শিক্ষার্থীদের। সেখানেই তাদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। মিনি গেস্টরুমে সিনিয়রদের চড়ে অনেক শিক্ষার্থীর কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুদের দিয়েও এই কক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীদের মারধর করানো হয়। শারীরিক নির্যাতনের সঙ্গে চলে মানসিক নির্যাতনও। বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিবার নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়।

গত সাত বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৫৮টি আলোচিত নির্যাতনের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এতে ভুক্তভোগী দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীকে হল ছাড়তে হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে ৪০, ২০১৪ সালে ২২, ২০১৫ সালে ১৪, ২০১৬ সালে চার, ২০১৭ সালে ১২, ২০১৮ সালে ২৬ এবং চলতি বছরে ২৮ জন শিক্ষার্থী হল ও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর আড়ালেও অনেক ঘটনা আছে যেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি বা ভয়ে নির্যাতনের শিকার অনেক শিক্ষার্থী মুখ খোলেননি। গেস্টরুম নির্যাতনের কারণে পরবর্তী সময়ে অসুস্থ হয়ে আবু বকর ও হাফিজুর মোল্লার মৃত্যু এবং ছাত্রলীগের কর্মীদের মারধরে এহসান রফিকের এক চোখ প্রায় দৃষ্টিহীন হওয়ার ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের প্রথম বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তারা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে পড়াশোনা করতে আসেন। ঢাকায় কোনো আত্মীয় থাকেন না কিংবা বাসা ভাড়া করে থাকার মতো আর্থিকভাবে সচ্ছলও নন তারা। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হল প্রশাসন বৈধ সিট বরাদ্দ দেয় না। ফলে আমাদের বাধ্য হয়েই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে হলে উঠতে হয়, তাদের কথামতো চলতে হয়। কোনো কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না গেলে বা কোনো বড় ভাইকে সালাম দিতে না পারলে গেস্টরুমে এর মাসুল গুনতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় বলেন, গেস্টরুম সংস্কৃতিটাকে ইতিবাচক হিসেবে আমরা দেখতে পারি। কারণ, একটা হলে সব বর্ষের শিক্ষার্থীরা থাকেন। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে ওঠার পর সিনিয়রদের চিনতেই অনেক সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে এবং বিভিন্ন বর্ষের সিনিয়রদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব হয় গেস্টরুমে। এছাড়া গেস্টরুমে অনেক বিষয়ে মতবিনিময় হয়। কারও কোনো সমস্যা হলে তাকে সাহায্যও করা হয়। তবে কিছু অত্যুৎসাহী ছেলেমেয়ে থাকে, যারা গেস্টরুমে নেতিবাচক কোনো কথা বলে থাকে বা কর্মকাণ্ড ঘটায়। এ ধরনের কোনো খবর পেলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।

তিনি বলেন, বর্তমানে কয়েকটি গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে, গেস্টরুমকে 'টর্চার সেলের' তকমা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। কোনো হলে কোনো টর্চার সেল নেই। এটা ভিত্তিহীন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, নির্যাতনের বিষয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নিচ্ছি। এটি অব্যাহত থাকবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার - dainik shiksha ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার - dainik shiksha ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জবি ছাত্রীর আত্মহত্যা: শিক্ষক-শিক্ষার্থী বহিষ্কার অবন্তিকার আত্মহত্যা: সাতদিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের আশ্বাস জবি উপাচার্যের - dainik shiksha অবন্তিকার আত্মহত্যা: সাতদিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের আশ্বাস জবি উপাচার্যের হয়রানির প্রতিকার চেয়েও ফল পাননি অবন্তিকা, অভিযোগ মায়ের - dainik shiksha হয়রানির প্রতিকার চেয়েও ফল পাননি অবন্তিকা, অভিযোগ মায়ের নতুন শিক্ষাক্রম: শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে মিলছে না মূল্যায়ন - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম: শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে মিলছে না মূল্যায়ন মূল্যায়ন বুঝলেও নৈপুণ্য অ্যাপে চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষকরা - dainik shiksha মূল্যায়ন বুঝলেও নৈপুণ্য অ্যাপে চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষকরা ‘পড়তে ও লিখতে’ শেখা প্রকল্প কেনো - dainik shiksha ‘পড়তে ও লিখতে’ শেখা প্রকল্প কেনো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023460388183594