ঢিল ছোড়ার অপরাধে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র গ্রেফতার

মেহেরপুর প্রতিনিধি |

মেহেরপুর পুলিশ এক শিশুর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারায় অভিযোগ গঠন করে। আদালত পুলিশের অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন মঞ্জুর করে।

পুলিশ ৭ বছর ১১ মাস বয়সের ওই শিশুকে ঈদের আগে গত শুক্রবার রাত দেড়টায় তার বাড়ি ঘেরাও করে, পরিবারকে কিছু না জানিয়ে ঘুম থেকে তুলে গ্রেফতার করে থানায় রাখে। পরদিন আদালতে পাঠায়।

ওই শিশুর নাম, মো. সিয়াম। তার বাবা মো. গিয়াস উদ্দিন, মা মৃত লতায়ারা খাতুন। তাদের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার পলাশীপাড়া গ্রামের পূর্বপাড়ায়। সে গাংনী পলাশীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে বিধির ৮৩ ধারায় বলা আছে, সাত বছরের বেশি এবং ১২ বছরের কম যে শিশুর বয়স, তার কাজকে প্রাথমিকভাবে অপরাধ গণ্য যাবে না।

তবে গাংনী থানার এসআই আশরাফুল ইসলাম (তদন্ত কর্মকর্তা) বাদীর দায়ের করা মামলায় ৬০ বছরের একমাত্র আসামিকে মামলা থেকে বাদ দিয়ে এই শিশুকে অভিযুক্ত করে। ঢিল ছুড়ে আঘাত করার অপরাধে পুলিশ তার বিরুদ্ধে ৩২৬ ধারায় অভিযোগ গঠন ও গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন করে আদালতে। মেহেরপুরের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট (গাংনী) আদালতের বিচারক শাহিন রেজা তা মঞ্জুর করেন।

আইনজীবীরা জানান, ৩২৬ ধারায় বলা আছে মারাত্মক অস্ত্র বা মাধ্যমের সাহায্যে গুরুতর আঘাত করলে কোনো ব্যক্তি এ ধারায় অভিযুক্ত হবে। যদিও মামলার চার্জশিটে শিশুটির বিরুদ্ধে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলার সময় ঢিল ছুড়ে আঘাতের কথা বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মেহেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি শফিকুল আলম বলেন, শিশুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও ৩২৬ ধারায় অভিযোগ গঠন এবং সেটা আদালতের গ্রহণ কোনোটিই আইনসিদ্ধ হয়নি। পুরো প্রক্রিয়ার সব আদালত ও পুলিশ দু’পক্ষের ভুল। মধ্যরাতে ঘুমন্ত শিশুকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে শিশুমনে আঘাত করা হয়েছে।

মামলার বাদী দেলোয়ার হোসেন জানান, গত বছর অক্টোবরের পাঁচ তারিখ বিকাল ৫টায় নিজবাড়ির আঙিনায় তার নাতি সাথী খাতুন (৭) আসামি ইনজাল কারিকরের (৬০) নাতী সিয়াম ও জিয়ার সঙ্গে খেলছিল। তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। এর জেরে ইনজাল কারিকর সাথীকে মারধর করে। সে পালাতে গেলে আসামি ইটের টুকরা ছুড়ে মারে।

তিনি জানান, এর পর নভেম্বরের ২৮ তারিখ এ অভিযোগে এনে মেহেরপুরে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট (গাংনী) বিচারক শাহিন রেজার আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি এজাহারভুক্ত করে অভিযোগ দাখিলের জন্য গাংনী থানা পুলিশকে নির্দেশ দেন। সাথী কসবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণির ছাত্রী।

তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আশরাফুল ইসলাম অভিযুক্ত নানাকে বাদ দিয়ে নাতিকে আসামি করে।

তার করা অভিযোগে বলা হয়, তদন্তকালীন সময়ে মামলার একমাত্র আসামির বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হলো। শিশুদের মধ্যে খেলার সময় আসামির নাতি সিয়াম পাকা রাস্তার পাথরের বালুকণা দিয়ে বাদির মেয়ে সাথীকে আঘাত করায় তার ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

তিনি বিষয়টি স্থানীয়দের জবানবন্দিতে প্রমাণিত হওয়ায় শিশু সিয়ামের বিরুদ্ধে ৩২৬ ধারায় অভিযোগ এনে চলতি বছরের মার্চের ১৬ তারিখ অভিযোগ প্রদান এবং ওই শিশুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন করেন আদালতে। আদালত তা মঞ্জুর করলে পুলিশ গ্রেফতার করে শিশুটিকে।

ওই শিশুর বাবা গিয়াস উদ্দিন জানান, কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছর আগে শিশুর মায়ের মৃত্যু হয়। একই আঙ্গিনায় সব শিশুর বাড়ি। খেলার সময় ছোট ইটের আঘাতে শিশু সাথী খাতুনের ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিছুদিনের মধ্যেই সেই চোখ স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু ঈদের আগে গত শুক্রবার গভীর রাতে পুলিশ তার বাড়ি ঘেরাও করে। আমাদের কিছু না জানিয়ে পুলিশ ঘুমন্ত অবস্থায় ওইদিন শিশু সিয়ামকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সকালে গাংনী থানায় গেলে পুলিশ এই মামলার কথা জানায়।

সাংবাদিকরা শিশু গ্রেফতারের ঘটনা জানতে গেলে নড়েচড়ে বসে পুলিশ। ওইদিন দুপুরেই জামিন আবেদন করলে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট (গাংনী) বিচারক শাহিন রেজার আদালত শিশুর জামিন মঞ্জুর করেন।

সরেজমিনে গেলে প্রত্যক্ষদর্শী আকলিমা বেগমসহ প্রতিবেশীরা জানান, শিশুদের মধ্যে খেলার সময় ছোট ঢিলের আঘাতে সাথীর চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে চিকিৎসা নিলে সেই চোখ স্বাভাবিক ও সুস্থ হয়ে গেছে। এ ঘটনায় মূল আসামিকে বাদ দিয়ে শিশুর বিরুদ্ধে মামলা ও শিশুকে গ্রেফতারের ঘটনা খুব অমানবিক ও অন্যায়।

এ সময় ক্ষতিগ্রস্থ শিশু সাথী খাতুন জানায়, ঘটনার কয়েকদিন পরই তার চোখ ভালো হয়ে গেছে। এখন সে দু’ চোখ দিয়েই ভালো দেখতে পায়।

অভিযোগে আসামি পরিবর্তন প্রশ্নে মামলার বাদী দেলোয়ার হোসেন (সাথীর বাবা) জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পয়সা খেয়ে মূল আসামিকে বাদ দিয়ে শিশুকে আসামি করেছে।

এ ব্যাপারে গাংনী থানার বর্তমান ওসি ওবায়দুর রহমান এবং মামলার কর্মকর্তার বক্তব্য নিতে চাইলে পাওয়া যায়নি।

মেহেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুস্তাফিজুর রহমান ঘটনা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে চাইলেও পরে তিনি বক্তব্য দেননি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, তদন্তে অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে মামলাটি দুর্বল হলো। শিশুটি অবিচারের শিকার হলো। যা নিন্দনীয়। বিচারক কিংবা পুলিশ পুরো মামলাটি ভালো করে পড়ে দেখলে এমন ভুল এড়ানো যেত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032718181610107