তারিকের রূপকথা

আনিসুল হক |

7e46c165985330d4e9cf643a00fc4ad0-Untitled-21কুষ্টিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস ছেলেটি গেল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁকে ডেকেছিল এমআইটি, ইয়েল, প্রিন্সটন এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়-আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো

তারিক আদনানকে নিয়ে আমার বিস্ময় যায় না। প্রথম বিস্ময়টা হলো, বাংলা মাধ্যমে পড়ে, কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক (২০০৮) আর কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক (২০১০) পাস করে তিনি সরাসরি ভর্তি হয়ে গেলেন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শুধু তো হার্ভার্ড নয়, কুষ্টিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস ছেলেটিকে ভর্তি করার জন্য ডেকেছিল এমআইটি, ইয়েল, প্রিন্সটন এবংকর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়-আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। হার্ভার্ডের কজন বন্ধু মিলে তাঁরা শুরু করেছেন স্টার্টআপ, ক্যালিফোর্নিয়ায় সেই প্রতিষ্ঠান এখন চলছে দারুণ। কী করে সম্ভব হয় এই রূপকথা!

তাই জানতে তাঁকে অনলাইনে কতগুলো প্রশ্ন করি। সান ফ্রান্সেসকো আর লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে তারিক সেসবের উত্তর পাঠিয়ে দেন। শুনতে চাই তাঁর শৈশবের কথা। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে চুয়াডাঙ্গা এবং কুষ্টিয়ায়, মা-বাবার চাকরিসূত্রে।

প্রাথমিক স্কুল ছিল চুয়াডাঙ্গা প্রদীপণ বিদ্যাপীঠ। প্রদীপণে পড়ার সময় আমার সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলো হলো পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে অংশগ্রহণ করা। এটা আমাকে অনেক ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছে যে বইয়ের বাইরেও একটা জগৎ আছে এবং সেখানে ভালো করা স্কুলে ভালো করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।’।

স্কুলের দিনগুলো?

আমার মা কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বদলি হওয়ার পর আমি কুষ্টিয়ায় এসে ভর্তি হই জিলা স্কুলে। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে আমরা কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের ইতিহাসে প্রথম ডিবেটিং ক্লাব খুলি। পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির অনেকটা সময় কেটেছে বিতর্কের সঙ্গে। বিতর্ক ক্লাবের দলনেতা হিসেবে আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে জিলা স্কুলের দলকে দেশের প্রথম সারিতে নিয়ে এসেছিলাম।’জীবনের মোড় আসলে ঘুরিয়েছে গণিত অলিম্পিয়াড।

সেই গল্পটা শুনি

গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৪ সালে। সে বছর পত্রিকার পাতায় জাতীয় অলিম্পিয়াডে নির্বাচনের জন্য বেশ কিছু কুইজ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো সমাধান করে জাতীয়তে যোগ দিলেও সে বছর ফিরতে হয়েছিল শূন্য হাতে!

এরপর ২০০৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে জুনিয়র বিভাগে দেশসেরার পুরস্কার পেয়ে যোগ দিলাম গণিত ক্যাম্পে। পরের বছরই জাতীয় দলে সুযোগ পাই। বাকিটা অনেকটা স্বপ্নের মতো। বিশেষত, গণিত ক্যাম্পের স্মৃতিগুলো আমার প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্যতম সেরা স্মৃতি।

গণিত ক্যাম্প এবং জাতীয় দলের অনেকেই দেশ ও বিদেশের সেরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে, করেছে। পাশাপাশি মুনির হাসান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং বিশেষত মাহবুব মজুমদারের মতো ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে এত ছোট বয়সে আসতে পারা আসলেই সৌভাগ্যের ব্যাপার।’

তারিকের বাবা শামসুর রহমান চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনে দীর্ঘদিন যাবৎ চাকরি করে বর্তমানে অবসরে। আর মা ড. মালেকা বিলকিস ঢাকার তিতুমীর সরকারি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর মা ছোটবেলা থেকেই তাঁকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে গণিত অলিম্পিয়াডের ক্যাম্প পর্যন্ত সব জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি উৎসাহ দিয়েছেন।

তারিক স্কুলে থাকতেই জড়িয়ে পড়েন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমের সঙ্গে। তাঁর ভাই রাফিদ সাদমান ঢাকা সিটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে তিনি ব্রোঞ্জপদক লাভ করেন।

সেসব দিনের কথা তাঁর মুখে, ‘২০০৯ সালে জার্মানিতে ১ নম্বরের জন্য ব্রোঞ্জ পাইনি, সেই দুঃখ দূর হয়েছিল ২০১০ সালে কাজাখস্তানে। কিন্তু সে বছর আবার ১ নম্বরের জন্য সিলভার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। সেসব নিয়ে যদিও এখন আর দুঃখ নেই, কীভাবে এ রকম কঠিন পরিস্থিতি থেকে উঠে এসে পরের বছর ভালো করতে হয়, সেই শিক্ষাটা গণিত অলিম্পিয়াড থেকেই পেয়েছি।’

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন কীভাবে? তিনি বলেন, ‘হার্ভার্ডে যাওয়ার ঘটনা বেশ মজার। মনে আছে, অ্যাডমিশন রেট দেখে ভেবেছিলাম হার্ভার্ডে সুযোগ পাওয়া অনেক দুঃসাধ্য। মাকে বলেছিলাম, চান্স তো পাব না, শুধু শুধু ১০০ ডলার আবেদন ফি নষ্ট করার কী দরকার?।

মা বলেছিলেন, “চান্স না পেলেও হার্ভার্ডের রিজেক্শন লেটার বাঁধিয়ে রাখব আমি আমার ঘরে!” মজার ব্যাপার হলো, হার্ভার্ড শতভাগ স্কলারশিপ দিয়ে আমাকে সুযোগ দিল। এরপর আমি আমার মাকে সেই চিঠি দিয়ে দিয়েছিলাম, আমার মা সেটা সত্যিই ফ্রেমে বাঁধিয়ে বাসায় এখনো টানিয়ে রেখেছেন।’

হার্ভার্ড থেকে বেরোনোর আগেই তাঁরা শুরু করেন স্টার্টআপ কোম্পানি। তিনি বলেন, ‘অনেক নামীদামি কোম্পানি থেকে অফার ছিল, কিন্তু হার্ভার্ড থেকে বেরোনোর সময় জানতে পারলাম আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু একটা ডেটা অ্যানালেটিকস কোম্পানি শুরু করেছে, যেটা হলিউডের মুভি নিয়ে বিভিন্ন তথ্যভিত্তিক সফটওয়্যার এবং ডেটা অ্যানালেটিকস টুলস তৈরি করছে।

তাদের সঙ্গে কথা বলে বেশ উৎসাহিত হলাম। জানলাম, সিলিকন ভ্যালির প্রথম সারির অনেক বিনিয়োগকারী এর মধ্যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চেয়েছে। কোম্পানির মূল বিনিয়োগকারী এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান হলিউডের নামকরা অভিনেতা।

নাম বলা মানা, আমাদের কাজ আড়ালের কাজ। আমি আরও চারজনের সঙ্গে যোগ দিলাম ডেটা সায়েন্টিস্ট এবং প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে। সব সময়ই সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপ কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে কৌতূহলী ছিলাম। তাই অন্য সব অফার ছেড়ে যোগ দিয়ে দিলাম।’

জানতে চাই, সেটা কেমন করছে। কাজ কী

তারিক বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি অনেক দূর এগিয়েছে। এখন ১৫ জনের মতো কাজ করছে। স্টার ওয়ার্সের মতো মুভিতে তারা ২০০ মিলিয়ন ডলারও খরচ করে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি খরচ হয় মুভির মার্কেটিংয়ে। তাই স্টুডিওগুলো জানতে চায়, ওই মুভি বক্স অফিসে কেমন আয় করবে।

অসম্ভব কঠিন একটা গাণিতিক সমস্যা। সেটা সমাধানের জন্য আমরা সার্চ ইঞ্জিন, সোশ্যাল মিডিয়া, মুভিবিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইটের লগের বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করি। এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটা গাণিতিক পরিমাপ বের করেছি।

তা থেকে আমরা বিভিন্ন মেশিন লার্নিং এবং গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে বের করি কোন মুভি কেমন জনপ্রিয় হবে; কিংবা কোন মুভির বিজ্ঞাপনে কী রকম সাড়া পড়বে। আমরা এরই মধ্যে প্রথম সারির বেশ কিছু স্টুডিওর কাছে এই তথ্য এবং সফটওয়্যার মাসিক ফিতে বিক্রয় করেছি। সামনে আরও অনেকে কিনতে আগ্রহী।

তারিকের কাছে জানতে চাই, তাঁর স্বপ্ন কী। কত দূর দেখেন তিনি?

‘আমার মূল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এমন কোনো প্রযুক্তির ওপর কাজ করা, যা সরাসরি মানুষের জীবনের উন্নয়নে কাজে আসে। হার্ভার্ডে শেষ বর্ষে স্বল্প মূল্যের কম্পিউটার ব্যবহার করে শিক্ষাদানপদ্ধতি উন্নয়নের প্রজেক্টের ওপর অনেক কাজ করেছি, যেটার নাম ছিল বাংলা পাই। সেটাকে এবং সেটার মতো বিভিন্ন আইডিয়া এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু হার্ভার্ড থেকে বের হওয়ার পর সিলিকন ভ্যালিতে এসে বুঝতে পেরেছি, তার জন্য আমার নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। পাড়ি দিতে হবে অনেক দূর পথ।’

তারিক নতুন বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের জন্য টিপস দিয়েছেন কতগুলো—

১. সব সময় নতুন কিছু করতে বা শিখতে চেষ্টা করো। শিক্ষাজীবনে নিজের দক্ষতার ওপর বিনিয়োগের চেয়ে কোনো ভালো বিনিয়োগ নেই।

২. ইন্টারনেট সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখো। ইন্টারনেটের ব্যবহার কেবল ফেসবুকে সীমাবদ্ধ নয়। বরং ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজেকে উন্নত করতে শেখো। কোর্সেরা বা এড এক্সের মতো ওয়েবসাইটে বিনা মূল্যে বিশ্ববিখ্যাত প্রফেসররা বিভিন্ন বিষয় শেখান। এসব থেকে একটু শিখতে পারলেও নিজেকে অনেক দূর নিতে পারবে।

৩. পাঠ্যবই বা পড়াশোনার বাইরে একটা বিশাল জগৎ আছে। সেটাকে চিনতে এবং জানতে চেষ্টা করো।

৪. সবশেষে যেই বিষয় ভালো লাগে, সেটা করো। আমাদের দেশে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে চাপ থাকে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, তোমার যদি কোনো বিষয় ভালো না লাগে, তাহলে সেটাতে জোর করার মাধ্যমে ভালো করা মোটেও সম্ভব নয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030379295349121