গভীর রাতে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের কর্মচারীদের ওপর বর্বর হামলা করেছে করোনার নমুনা সংগ্রহের জন্য অস্থায়ী বুথের স্বেচ্ছাসেবকরা। শুধু তাদের ওপর হামলা নয় এ সময় স্বেচ্ছাসেবীরা সন্ত্রাসের মতো কর্মচারীদের বাসভবনেও হামলা চালিয়েছে এমনটাই দাবি করেছেন কলেজের ছাত্রছাত্রী ও কর্মচারীরা। এই ঘটনায় কলেজ স্টাফদের ২৫/৩০ কর্মচারী আহত হন।
কলেজের কর্মচারীরা দৈনিক শিক্ষাকে জানান, ২ জুন রাত ২টার দিকে ছেলেদের থাকার জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী মেয়েদের ঘোরাঘুরি করতে দেখে। এ সময় একজন মেয়ে বুথের ভেতরে প্রবেশ করে। করোনা বুথের দুজন ছেলে এবং একজন মেয়েকে একসঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় থাকতে দেখা যায়।
জানা যায়, কলেজের কর্মচারীদের কয়েকজন এতে বাধা দেয়ায় তাদের লাঠিপেটা, ঘরবাড়ি ভাংচুর, চাপাতি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। স্টাফদের দাবি অসামাজিক কার্যকলাপে বাধা দেয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাছাড়া ঘরে থাকা ঘুমন্ত শিশু-বৃদ্ধ-নারীদেরও নির্যাতন ও মারপিট করা হয়। বর্বর হামলা করেছে করোনা বুথের কর্মীরা। কলেজের স্টাফদের কুপিয়ে আহত করেছে, মা-বোনদের শারীরিক নির্যাতন করার পর তালাবন্দি করে দেয় এই বহিরাগতরা। ধারালো চাপাতির কোপে তিতুমীর কলেজের কর্মচারী জাবেদ ও শাহাবুদ্দীনের অবস্থা গুরুতর হলেও তাদের হাসপাতালে পাঠানোর সুযোগও দেয়া হয়নি বলে জানান ওইদিন কলেজে ডিউটিরত এক নিরপত্তা কর্মচারী।
করোনা বুথের দায়িত্বরত সিইও নারীদের নিয়ে বেহায়াপনা ও মদ্যপানে লিপ্ত থাকার সময়ে তাকে নিষেধ করার ফলেই কলেজের কর্মচারীদের ওপর নৃশংস এই হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন কলেজের আশপাশের অনেকেই। এদিকে, আহত কলেজ কর্মচারীরা আরো জানান, হামলার পরে তারা ওই রাতেই কলেজের প্রধান ফটকে এসে মানববন্ধন মিছিল বের করে। ধারালো চাপাতির কোপে তিতুমীর কলেজ স্টাফ জাবেদ ও শাহাবুদ্দীনের অবস্থা গুরুতর হলে তাদের হাসপাতালে পাঠানের সুযোগটুকুও দেয়া হয়নি।
বিশ্বে করোনার মহামারি, দেশেও আতঙ্ক। আক্রান্ত অনেক মানুষ। তাই সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে বেশ কিছু সংস্থাও। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার। তারা গত দুমাস ধরে ক্যাম্প চালিয়ে আসছিল রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে। কিন্তু সর্বশেষ তারা কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার রাত রারটার পর থেকেই ৩ বার দফায় দফায় হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। তিতুমীর কলেজের ৪র্থ শ্রেণির কর্মকর্তাদের সাথে জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ারের কর্মীদের মাঝে রণক্ষেত্র চলতে থাকে।
জানা যায়, কলেজ স্টাফদের ভিতরে আটকিয়ে রেখে সর্বশেষ রাত দুইটার হামলার পর রাস্তায় এসে স্লোগান দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা দাবি করে জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ারের কর্মীরা। ঘটনার পরে তিতুমীর কলেজে প্রশাসন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা জেগে উঠেছে।
ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে জানতে চাইলে তারা জানান, গত রোববার ছেলেদের থাকার জায়গায় একজন মেয়েকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। ভেতরে প্রবেশ করতেই করোনা বুথের দুজন ছেলে এবং একজন একটি মেয়েকে নিয়ে অনৈতিক কার্যকলাপের সময় কলেজের কর্মচারীরা প্রতিবাদ করে। তারা বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে উল্টো কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিতে থাকে। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে দশটার দিকে দুজন কর্মীকে তারা কলেজ গেটে মারধর করে। এরপর রাত ১২টার দিকে আমরা কয়েকজন তাদের কাছে কী কারণে আমাদের কর্মীদের মারধর করা হয়েছে জানতে গেলে তারা বলে তোরা এখানে থাকতে চাইলে ভালোভাবে থাক না হলে, চলে যা। এরপর আবার বিতর্কের এক পর্যায়ে চড়াও হয় জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ারের কর্মীরা।
নাম প্রকাশে তিতুমীর কলেজের এক কর্মচারী জানান, ওই হেলথকেয়ারের কর্মীরা কলেজে রাত-দিন গান বাজনা করে। এমনকি রমজানের তারাবির সময়ও এমন করেছে। মেয়েদের অবাধ চলাফেরা ছিল সেখানে। আমাদের পরিবার ও মহল্লার লোকজন অভিযোগ ও দিয়েছিল। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কলেজের কর্মচারীরা প্রতিবাদ করে। শুরু সেখানে থেকেই। এরপর হেলথ কেয়ারের একজন মহাখালীর গাউসুল আজম মসজিদের সামনে মেয়ের সঙ্গে অসামাজিক কার্যকলাপে ধরা পড়েন। বিষয়টা কলেজের প্রিন্সিপাল পর্যন্ত গড়ায়। পরে মীমাংসা করা হয়। এরপর গত ২ জুন রাতে কলা ভবনে তাদের একজনকে মেয়েসহ আপত্তিকর অবস্থায় ধরে ফেলে কলেজ কর্মচারীরা। এর মাঝে কামরুজ্জামান নামে এক অফিসারের রুমে গভীর রাতে এক মেয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু কর্মচারীদের বাধায় ঢুকতে পারেনি। এ সবকে কেন্দ্র করে তারা হামলা করে এমনটাই জানা গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা তৃতীয় শ্রেণি কর্মচারী পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, কলেজের কর্মচারীদের ওপর নির্মম হামলার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবিতে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো: মাহবুব হোসেন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বরাবর আবেদন করবেন।
এ বিষয়ে তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রিপন মিয়া বলেন, আমরা এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাই। গভীর রাতে দরজা ভেঙে হামলার ঘটনায় কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাছাড়া এই হামলার মাধ্যমে বোঝা যায় তারা কেমন উচ্ছৃঙ্খল।
এই বিষয়ে সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক জুয়েল মোড়ল বলেন, আমাদের তিতুমীর কলেজে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। এই হামলার ঘটনায় নিন্দা জানাই। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে বিষয়টি মীমাংসা করেছে। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা কোনো সাংগঠনিকভাবে নিন্দা জানিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা কোনো বিবৃতি দেইনি। এটা কলেজের ব্যাপার আমরা এখন কলেজে যাই না। তবে এই হামলার ঘটনায় আমরা দুঃখ প্রকাশ করেছি।
এই বিষয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের আহ্বায়ক ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা করোনা সংক্রমণ রোধে কাজ করে যাচ্ছি নমুনা সংগ্রহ করতে দুমাস আগে থেকেই মাঠে আছি। নার্স স্বেচ্ছাসেবীসহ যারা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে তাদেরকে ট্রেনিং দিচ্ছি। সেই ট্রেনিং সেন্টারটা আমরা সরকারি তিতুমীর কলেজে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে অনুমতি নেই এবং স্থাপন করি। এখানে আমাদের প্রায় ১৭৫ জনের মতো স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করেন। তিতুমীর কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের সহযোগিতা করেছেন আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছিলাম কিন্তু এর মধ্যে তিতুমীর কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তারা সব সময় একটা নেগেটিভ আকার-ইঙ্গিতে দিতেন। কারণ তারা ভাবতো আমাদের মাঝখান থেকে তারা করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। যেহেতু আমাদের কর্মীরা করোনা নিয়ে কাজ করছে। তারা অনেক সময় মেয়েদের ইভটিজিং করেছে পানি গ্যাসের লাইন কেটে দিয়েছে। মসজিদে যখন নামাজ পড়তে যেতে চাইতো তখন তারা স্বাস্থ্যকর্মীদের বাধা দিত। এ রকমভাবে চলছিল আরকি। হঠাৎ এই ঘটনাটি ঘটে আমাদের ছেলেদের তারা রড দিয়ে পিটিয়েছে মেয়েদের তারা বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে তাদের গয়না-গাটি গলা থেকে টান দিয়ে নিয়ে গেছে।
কি নিয়ে তাদের সঙ্গে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্মচারীরা চাচ্ছে না যে করোনাভাইরাসের বুথগুলো এখানে এটা ভাবছে। কর্মচারীরা তাদের পরিবার নিয়ে এখানে থাকে এটাই ছিল তাদের মূল সমস্যা। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির মাধ্যমে তারা ছেলেদের এবং মেয়েদের ওপর হামলা করে।
এই বিষয়ে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, এই বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা যে অভিযোগ করেছে সেটা মিথ্যা। আমি দ্বিমত পোষণ করি। উনি বলেছে মসজিদের ব্যাপার। পানি থাকে না, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা আছে যে করোনায় সেবায় যারা দিবেন তারা পাবলিক প্লেসে ঘোরাঘুরি থেকে বিরত থাকুন। তারা মসজিদে যেত ওপেন ঘোরাঘুরি করতো এটা আসলে কোনোভাবে কাম্য ছিল না। উনি বলেছেন মনোমালিন্যের জের ধরে এই ঘটনাটি ঘটেছে।
কী কারণে মনোমালিন্য হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পানি বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখা এগুলো শুধু অজুহাত। মূল ঘটনা এসব না। মূল ঘটনাটি হলো নারী সংক্রান্ত ঘটনা। ঘটনার দিন রাতে এক নারী স্বাস্থ্য কর্মী সেদিন ৪০০-৫০০ গজ হেঁটে এসে পুরুষ সহকর্মীদের বিল্ডিংয়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা সেই মেয়েকে বাধা দেয়। এ সময় আমাদের কলেজ নিরাপত্তাকর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিলেন তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।
মেয়েটি বলেন কামরুজ্জামান নামে এক সুপারভাইজারের কাছে তিনি যাবেন। কোনোভাবে তাকে আটকে রাখা যাচ্ছিল না। এরপর ওই সুপারভাইজার নিচে নেমে এসে ওই মেয়েটিকে তার রুমে নিয়ে যায়। এরপর এই বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এরপর আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে পুলিশকে জানান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরে আজম মিয়া বলেন, এই ঘটনায় পুলিশ কঠোর অবস্থানে ছিল। তবে বিষয়টি মীমাংসার পথে। আমরা আবারও যদি এই বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাই তাহলে আইনত ব্যবস্থা নিবো।
এ ঘটনার তিব্র নিন্দা জানিয়ে তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ মো. আশরাফ হোসেন বলেন, যতটুকু শুনেছি আমাদের স্টাফদের অনেককে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে আলোচনা করে আমরা করণীয় ঠিক করব। তাছাড়া এ হামলার ঘটনা অতি নিন্দনীয়। আমরা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম দেখা যাক পরিস্থিতি কি হয়। তিতুমীরের যারা আহত হয়েছে তাদের সাথেও যোগাযোগ করছি, তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি।