দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের অংশ হিসেবে পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে একবেলা খাবার দেয়া হবে। খাবার হিসেবে বিস্কুট, রান্না করা খাবার বা ডিম, কলা দেয়া হবে। এ ব্যবস্থা রেখে ‘জাতীয় স্কুল মিলনীতি-২০১৯ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়।’ সরকারের এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। এটাকে মহতী উদ্যোগও বলা চলে। গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবারের ছেলেরা দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পায় না। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম।

। অভাবের সংসারে তারা বিদ্যালয়ে যাবেই বা কী করে? যখন তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স তখন বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবন সংগ্রামে শরিক হতে হয়। আবার কিছু দিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার পর আবার বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ ঝড়ে পড়ে। সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯৪৭টি। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৯৩টি আর বেসরকারি ৬৮ হাজার ৫৫৪টি। নিবন্ধনকৃত ১৩৪, নিবন্ধন নয় এমন বিদ্যালয় ৪ হাজার ৫৭০ এবং অন্যান্য ৬৩ হাজার ৮৫০টি। আর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ১০০।

বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে উপবৃত্তি চালু, যথাসময় শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার ফলে শিক্ষার্থী আর শিক্ষার মান বাড়ছে। অপরদিকে শিক্ষকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে এবং দিচ্ছে। উল্লেখ করতে হয় যে, গত প্রায় ৪০ বছর ধরে দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অবহেলিত ছিল। তারা মানবেতর জীবনযাপন করতেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ জানুয়ারি ২০১৩ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক সমাবেশে একটি ঘোষণার মাধ্যমে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১ জানুয়ারি ২০১৩ সাল থেকে জাতীয়করণ করে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হয়। শিক্ষকরা আর্থ-সামাজিকভাবে তাদের মর্যাদা ফিরে পান।

বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯টি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উন্নতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (পিটিআই) স্থাপন করা হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (সিইনএড) কোর্সের পরিবর্তে ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১২ সাল থেকে প্রথম পরীক্ষামূলক ৭টি পিটিআইতে ১৮ মাস মেয়াদি এই কোর্স চালু করা হয়েছে। দেশে ৬৭টি সরকারি এবং ২টি বেসরকারি পিটিআই রয়েছে। ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৭৪ জন শিক্ষককে ডিপিএড প্রশিক্ষণ দেয়া হবে (সূত্র : পিইডিপি-৪, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়)। ডিপিএড সার্টিফিকেট প্রদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট। উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য উপজেলা রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষায় দক্ষ করার জন্য আইসিটি ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। আইসিটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকরা মাল্টিমিডিয়ার দ্বারা শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নিতে পারবেন। সরকার ইতোমধ্যে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া সরবরাহ করেছে। যাতে শিক্ষকরা ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নিতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কার্যাবলী সহজ, সাবলীল, আনন্দঘন ও শিখন ফল স্থায়ী হবে। ২০ হাজার শিক্ষককে ১ বছর মেয়াদি আইসিটি ট্রেনিং দেয়া হবে (সূত্র : পিইডিপি-৪, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়)। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতি বছর ১ জানুয়ারি বিনামূল্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। আর সরকার এই দিনকে ‘জাতীয় বই উৎসব দিবস’ হিসেবে পালন করছে। আগে যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক পেতে অনেক সময় লেগে যেত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐক্লান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৯ সাল থেকে বছরের প্রথম দিনেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ১০ কোটি ৩৬ লাখ পাঠ্যপুস্তক দেয়া হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন আনা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও নতুন নতুন তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু হয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ১০০% যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া হবে। ২০১৭ সালে প্রায় ২৬.৬৩ লাখ পরীক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং ৯৫.১৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করে। এ পরীক্ষা থেকে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ট্যালেন্টপুলে ও সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির হার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্রছাত্রী ভর্তির হার বৃদ্ধির জন্য উপবৃত্তি অনেকাংশে অভিভাবকদের সহায়তা করছে। ২০১১ সালে ছাত্রছাত্রী ভর্তির হার ছিল শতকরা ৯৪.৯০। ৬ বছরের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের জোরালো মনিটরিংয়ের ফলে এবং ঐক্লান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালে ছাত্রছাত্রী ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ৯৭.৯৭।

বর্তমান সরকারের শিক্ষাবান্ধব উদ্যোগের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর ঝরেপড়ার হার আগের চেয়ে অনেক কমেছে। ২০০৭ সালে ছাত্রছাত্রী ঝরেপড়ার হার ছিল শতকরা ৫০.৫০। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০১৭ সালে ছাত্রছাত্রী ঝরেপড়ার হার কমে দাঁড়ায় শতকরা ১৮.৮০ (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮)। বর্তমান সরকারের আমলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। পূর্বে ১ম ও ২য় শ্রেণীর জন্য বার্ষিক সংযোগ সময় ৫৯৫ ঘণ্টা এবং ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর জন্য ৮৩৩ ঘণ্টা ছিল। প্রায় ৪ হাজার দুই শিফটের বিদ্যালয়কে এক শিফটে রূপান্তরিত করার ফলে এক শিফটের বিদ্যালয়ে ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ৮২২ ঘণ্টা এবং ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীতে ১৪৭৭ ঘণ্টা করা হয়েছে।

দুই শিফটে বিদ্যালয়ে ১ম ও ২য় শ্রেণী এবং ৩য় থেকে ৫ম শেণীর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৭১৪ ঘণ্টা এবং ৭৮৩ ঘণ্টা করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। পূর্বে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি সমমান নির্ধারণ করা ছিল। বর্তমানে নারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি সমমান নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকদের বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন। শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য এবং শিক্ষক স্বল্পতা দূর করার জন্য আরও ১ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে (সূত্র : পিইডিপি-৪, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়)।

শিক্ষার্থীদের ক্লাসকে আরও আনন্দপূর্ণ ও প্রাণবন্ত করে তুলতে সরকার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্রীড়া ও সঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেবে। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিইডিপি-৪ এর অধীনে ৫ হাজার ১০৬ জন ক্রীড়া ও সঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া এবং সঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, মানবিক, নান্দনিক, আবেগিক বিকাশে ও সামর্থ্য বাড়াতে এবং রুচিশীল করতে এ দুইটি বিষয় অনেক সহায়তা করবে। একজন শিক্ষার্থীকে আগামী দিনের যোগ্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ক্রীড়া ও সঙ্গীত তাদের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলবে। শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ ও দৈহিক সামর্থ্য বাড়াতে আর সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের মানসিক উৎকর্ষতা সাধন, উন্নত রুচি ও আবেগ বিকাশে সাহায্য করবে। একজন যোগ্য আদর্শ সুনাগরিক গঠনে এ দুটি বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040719509124756