দৃঢ় হোক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি

শরীফুল্লাহ মুক্তি |

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বা Pre-primary Education। আমাদের দেশের মূল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় একটি নবতর সংযোজন। সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনার আলোকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে একটি স্বতন্ত্র ও পৃথক শ্রেণী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের নির্ধারিত ‘সহস্র্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা অর্জনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। মানসম্মত ও একীভূত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে ও ঝরে পড়ার হার কমাতে এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর হার বাড়াতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বলতে সাধারণত শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা তথা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পূর্বে প্রস্তুতিমূলক যাবতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশমূলক কার্যক্রমকে বোঝায়।

বিগত দশকগুলোতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের ফলে আমরা প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সংখ্যাগত দিক অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে আমরা কাজ করছি মানসম্মত ও একীভূত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে। মানসম্মত ও একীভূত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রাথমিক শিক্ষায় সয শিশুর স্বতঃস্ফূর্র্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। আর প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশুর স্বতঃস্ফূর্র্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সব শিশুর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাক্রম সফলভাবে সম্পন্নকরণ। শিশুকে বিদ্যালয়মুখী বা বিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুত করার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটায় এবং আজীবন শিখনের ভিত্তি তৈরি করে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম সোপান ও প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার একটি বিস্তৃত পরিসরের সূচনার অংশ হলো প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা।

আমাদের দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গতানুগতিক ধারণা অনেক পুরাতন। ইতিপূর্বে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কোন কর্মসূচি আমাদের দেশে জাতীয়ভাবে চালু না থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘শিশু শ্রেণী’ বা ‘ছোট ওয়ান’ নামে অনেক আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে চালু ছিল। যদিও এসব শিক্ষায় শিশুর সার্বিক বিকাশ ও আধুনিক শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি তেমনভাবে অনুসরণ করা হয়নি। ঐতিহাসিকভাবে কোন রকম স্বীকৃতি ছাড়াই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে স্বতঃস্ফূর্ত ও অনানুষ্ঠানিক ‘শিশু শ্রেণী’ বা ‘ছোট ওয়ান’ গড়ে ওঠে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। জাতীয় পর্যায়ে কোন সর্বজনীন শিক্ষাক্রম না থাকায় এসব সংস্থা তাদের স্ব-উদ্ভাবিত শিক্ষাক্রম ও শিখন-শিক্ষণ সামগ্রী ব্যবহার করে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে (পিইডিপি-১ ও পিইডিপি-২) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতিমূলক শিক্ষার অংশ হিসেবে শিশু শ্রেণীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়; যদিও তা অনেকংশে বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে মার্চ মাসে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি পরিচালনা কাঠামো সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এই পরিচালনা কাঠামোতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃতি, আওতা, মানের যৌক্তিকতা, প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য ও বিদ্যালয়ভিত্তিক কর্মসূচি পরিচালনা সম্পর্কে কিছু দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রথম ২০১০ সালে সরকারিভাবে অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী চালু করা হয়; যেখানে ৫ থেকে ৬ বছর বয়সী সকল শিশু এক বছর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা সারা দেশে সব সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি স্বীকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাস্তর হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।

শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বলতে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করার আগে শিশুর অন্তর্নিহিত অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতূহল, আনন্দবোধ ও অফুরন্ত উদ্যমের মতো সর্বজনীন মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশ এবং প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবেশ তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিশুর শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি ও প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা হিসেবে ৫+ বছর বয়স্ক শিশুদের জন্য প্রাথমিকভাবে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ৫ও ৬ বছর বয়সী শিশুদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ভাষাগত ও সামাজিক বিকাশের মজবুত ভিত্তি তৈরি করে থাকে। এ ভিত্তি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য একটি প্রস্তুতিমূলক স্তর যা শিশুর শিক্ষা, বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরণ পর্যায় হিসেবে স্বীকৃত। একটি শিশুর জীবনে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও বিদ্যালয়ভিত্তিক আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে সরকার আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর পূর্ববর্তী এক বছর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নির্ধারিত করেছে। কিন্তু বাস্তবে এর ব্যাপ্তি ও পরিধি শুধু এই সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো, শিশুর শিক্ষা ও বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, সুকুমার বৃত্তির অনুশীলন, অন্যের প্রতি সহনশীলতার মনোভাব তৈরি এবং পরবর্তী আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শৃঙ্খলাবোধ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের প্রস্তুতির জন্য নয় শিশুর সারা জীবনের শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো ‘আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বয়সী শিশুদের (৫+বছর) বয়স ও সামর্থ্য অনুযায়ী শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক, নান্দনিক, বুদ্ধি বৃত্তীয় ও ভাষাবৃত্তীয় তথা সার্বিক বিকাশে সহায়তা দিয়ে আজীবন শিখনের ভিত্তি রচনা করা এবং প্রাথমিক শিক্ষার অঙ্গনে তাদের সানন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিষেক ঘটানো।’ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো‘আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে বিভিন্ন খেলা ও কাজের মাধ্যমে শিশুর সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা, শেখার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা, শিশুর সৌন্দর্য-নান্দনিকতাবোধ-সুকুমারবৃত্তি বিকাশে সহায়তা করা, শিশুকে পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করা, শিশুকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক আচার-কৃষ্টি-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি এর চর্চায় উৎসাহিত করা, নৈতিকতা-মূল্যবোধ-সামাজিক রীতিনীতি বিকাশে সহায়তা করা, শিশুর স্থূল ও সূক্ষ্ম পেশি তথা চলনশক্তির বিকাশে সহায়তা করা, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা করা, শিশুর ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা, প্রারম্ভিক গাণিতিক ধারণা-যৌক্তিক চিন্তা-সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করা, পরিবেশের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কারণ ও ফলাফল সম্পর্ক অনুধাবনে সহায়তা করা, শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত কল্পনা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশে সহায়তা করা, শিশুর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বিকাশে সহায়তা করা এবং নিজের কাজ নিজে করতে উদ্বুদ্ধ করা, আবেগ বুঝতে পারা ও তার যথাযথ প্রকাশে সহায়তা করা, শিশুকে প্রশ্ন করতে আগ্রহী করে তোলা ও মতামত প্রকাশে উৎসাহিত করা, শিশুকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা।’

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বিষয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক লক্ষ্য হচ্ছে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের শিক্ষার অধিকার পূরণ করে শিক্ষার সুযোগসমূহ থেকে পূরোপুরি সুফল অর্জন এবং মানব সম্ভাবনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বৃদ্ধি ও বিকাশে তাদের সক্ষম করে তোলা। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নানাবিধ।

প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা : শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রধানতম উপায় হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমান সময়ে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, যারা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েনি তাদের তুলনায় যারা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করে। শিশুর বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পাঠ প্রস্তুতির পাশাপাশি শিশুকে বিদ্যালমুখী করা, শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা, বিদ্যালয়ভীতি দূর করা এবং বিদ্যালয় কেন্দ্রিক নিয়মনীতির অভ্যাস ও চর্চা করার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিশুর সারা জীবনের শিক্ষার ভিত তৈরি : শিশুর শিক্ষার ভিত তৈরির জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাস্তর একটি স্বীকৃত স্তর। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর শিক্ষার গাঁথুনি তথা ভিত তৈরির জন্য কাজ করে। শিশুর মস্তিষ্ক তথা ব্রেনের বিকাশের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাস্তর হলো উল্লেখযোগ্য সময় যা শিশুর পরবর্তীকালের শিক্ষার ভিত রচনা করতে সহায়তা করে। এ বয়সে শিশুর মস্তিষ্ক শেখার জন্য দ্রুত কাজ করে এবং বেশি সক্রিয় থাকে।

পরিবার ও বিদ্যালয়ের সেতুবন্ধন : প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর বিদ্যালয়ে প্রস্তুতির পাশাপাশি পরিবার ও বিদ্যালয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুকে শুধু বিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুত (Ready for school) করে না, তাকে কৃতকার্যতার সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণে (Successful Transition) সহায়তা করে। শিশুকে ভালোভাবে পরিবার থেকে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে যেতে প্রস্তুত করতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার (বিদ্যালয়ের) নিয়মনীতি : শিশুর বিদ্যালয়ে খাপ খাওয়ানো ও শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। লেজার এবং ডারলিংটন (১৯৮২) পরামর্শ দিয়েছেন যে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা শিশুদের নিষ্ক্রিয় থেকে সক্রিয় শিক্ষার্থী হিসেবে উন্নীত করে। বিভিন্ন রকম আনন্দদায়ক কাজ  ছড়া, গান, গল্প, খেলা, অভিনয় ও বিভিন্ন প্রকার খেলনার সাহায্যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হয় বলে শিশুর কাছে বিদ্যালয় একটি আনন্দদায়ক স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়।

শিশুর ভালো আচরণ গঠন : শিশুর ভালো আচরণ গঠনের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর প্রারম্ভিক বয়সে যে আচরণ ও অভ্যাসের মধ্য দিয়ে বড় হয়, তা শিশুর সারা জীবনের আচরণে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে তাদের বুদ্ধি বৃত্তীয় দক্ষতা, বিদ্যালয় প্রস্তুতি এবং সামাজিক দক্ষতা যারা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়েনি তাদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই, শিশুর প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা তার আচরণ গঠনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

শিক্ষা জীবনকে দীর্ঘ করা : বিদ্যালয়ের ঝরে পড়া রোধ, বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি ও সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ভূমিকা রয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপ এবং নেপালে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, যে সব শিশু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সফলভাবে সম্পন্ন করেছে তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অকৃতকার্র্যতা, পুনরাবৃত্তি, অনুপস্থিতি এবং ঝরে পড়ার হার কম (Caroline Arnold, 2003)। এই শিক্ষা বিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পর্যন্ত টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা হার বৃদ্ধি : বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ভালো করার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিশুর জীবনে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ধনাত্মক প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব শিশু প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে তারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষায় (যেমন ভাষা শিক্ষা, গণিত, সমস্যা সমাধান, সমাজ ও অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা) অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফল করেছে।

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৩) এর আওতায় প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রায় সব বিদ্যালয়ে (নব্য জাতীয়করণ ব্যতীত) প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগকৃত সব শিক্ষককে উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে ১৫ দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য ‘শিক্ষক-সহায়িকা’ ও শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আমার বই’ প্রণয়ন করা হয়েছে। তাছাড়াও স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের চার্ট, ফ্লিপচার্ট, ফ্লাসকার্ড, গল্পের বই, এসো লিখতে শিখি, খেলার সামগ্রী ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে।

দৈনিক সমাবেশ, ব্যয়াম, সৃজনশীল কাজ (ছড়া, গান, নাচ, গল্প, চারু, কারু ও অভিনয়), ভাষার কাজ, গণিতের কাজ, খেলা (ইচ্ছেমতো খেলা ও নির্দেশনার খেলা), অন্যান্য কাজ (পরিবেশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা) ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বৃদ্ধি ও বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সৃজনশীল কাজগুলো কোমলমতি শিশুদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক আনন্দ দিতে সক্ষম। ব্যায়াম ও খেলাগুলো শ্রেণীকক্ষের একঘেঁয়েমি দূরীভূত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। অনেক শিক্ষক ছড়া এবং গানগুলো খুবই মজা করে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করেন। অনেক প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক বিভিন্নভাবে ইউটিউব থেকে নির্ধারিত ছড়া ও গানগুলো সংগ্রহ করেছেন এবং ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান করছেন।

শিক্ষক-সহায়িকায় প্রদত্ত নির্দেশনা মোতাবেক সাপ্তাহিক ক্লাস রুটিন তৈরি করে দৈনিক ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট বিভিন্ন বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক শ্রেণী-কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এমনটি নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কিছু সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান পরিচালনা করা হলেও অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তা হচ্ছে না। আবার বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো কক্ষটিকে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও অনেক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীটি অবহেলিত। এমনকি অনেক বিদ্যালয়ে বারান্দায় এবং গাছতলায় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীর কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়। বছর বছর প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী সজ্জিতকরণের জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী নীতিমালা অনুযায়ী সজ্জিত করা হয়নি। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে চারটি কর্ণার (কল্পনার কর্ণার, ব্লক ও নাড়াচড়ার কর্ণার, বই ও আঁকার কর্ণার, বালি ও পানির কর্ণার) থাকার কথা থাকলেও খুব কম সংখ্যক বিদ্যালয়ে তা দেখা যায়। অনেক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে প্রয়োজনীয় উপকরণ পর্যন্ত নেই। কিছু শিক্ষক শিক্ষক-সহায়িকা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে গতানুগতিকভাবে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অনেক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের যথাযথ নিয়মে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। শিক্ষক-সহায়িকায় অনানুষ্ঠানিক, গাঠনিক ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন (One to one approach) করার জন্য নির্দেশনা থাকলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীতে আনুষ্ঠানিক ও সাময়িক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। শিক্ষক-সহায়িকায় প্রদত্ত ছকে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।

একটি শিশুর প্রাক-প্রাথমিক স্তর সফলভাবে সমাপনের মূল দায়িত্ব বর্তায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকের ওপর। শ্রেণীকক্ষে একটি শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও বজায় রেখে যথাযথভাবে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া পরিচালনা করা একজন শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষককে তাই হতে হবে বন্ধুর মতো। শিশুর সঙ্গে তিনি এমনভাবে মিশে যাবেন, কথা বলবেন অথবা যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া স্থাপন করবেন যাতে শিশু পরম আস্থার সঙ্গে তার ওপর নির্ভর করতে পারে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের ভূমিকা হবে তাই সহায়তাকারীর যিনি শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে পদে পদে শিশুকে নানা কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে তাকে নানাভাবে শিখতে সহায়তা করবেন। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সুফল পেতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্ধারিত উপকরণসমৃদ্ধ আলাদা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-সহায়িকায় প্রদত্ত নির্দেশনা মোতাবেক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করা এবং বছর শেষে নির্ধারিত যোগত্যাগুলো অর্জন করানো নিশ্চিত করা। আর এর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের ইতিবাচক মনোভাব।

[লেখক :ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার (ইউআরসি), বারহাট্টা, নেত্রকোনা]

সূত্র: দৈনিক সংবাদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002748966217041