দৈনন্দিন শিক্ষা এবং পুঁথিগত বিদ্যার সমন্বয়ে গড়ে উঠুক সুশিক্ষা

রহমান মৃধা |

কেবল স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ শিক্ষাই কি সঠিক শিক্ষা? পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি কর্মজীবনের পথ নির্দেশনার গাইডলাইন মাত্র। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষা বলে যে একটি কথা রয়েছে তার সমন্বয়ে যখন পুঁথিগত শিক্ষার আবির্ভাব ঘটে এবং সে শিক্ষা যদি মানবকল্যাণে সুন্দর, সময়োপযোগী ও মূল্যবোধসম্পন্ন হয়, তখনই তাকে বো যায় সুশিক্ষা। তাই একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায়, শিক্ষা নয়, সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। 

এখন প্রশ্ন হলো, কী করে পাব এই সুশিক্ষা? আছে কি বাংলাদেশে এমন কোনো উদাহরণ, যা তুলে ধরার মতো? অবশ্যই আছে। নিজের ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরি। আমার বাস্তব এবং দৈনিক শিক্ষার থেকে যে বিষয়গুলো বিবেকের মাঝে ঢুকেছে স্বল্প দিনের মধ্যে এক নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচিত হবার পর, তা উল্লেখ না করলেই নয়। ছেলেটির নাম শাহজাহান মিয়া। মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের এক পরিচিত নাম। সবাই তাকে চিনতে পারে, তবে আমার সঙ্গে তার পরিচয় কিছুদিন আগে। একজন অসহায় ব্যক্তির বিপদে সাহায্যের হাত বাড়াতে সে লিখেছে, তার একটি পোস্টে যা আমার চোখে ধরা পড়েছিল, এই তো সেদিনের কথা।

পোস্টটি পড়তেই মনে পড়েছিল ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই’! তার সেই মহৎ কাজের সাথী হতে তাকে চেনা জানার সুযোগ মিলেছে। সে পেশায় একজন ব্যাংকার, বাংলার অতি সাধরণ পরিবার থেকে স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা কলেজে থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে এবং তার স্ত্রী, সেও ইডেন থেকে এমএসসি সম্পন্ন করে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত, তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। একজন আদর্শ মানব জাতির পরিচয় হিসাবে এটা যথেষ্ট যে, সে একটি কর্মের সাথে তার নিজের পরিবার যেখানে ভাই-বোন এবং তাঁদের পরিবার সঙ্গে বাবা-মাকে নিয়ে গ্রামের এক আদর্শ পরিবেশে দিব্যি যাপন করে চলেছে স্বচ্ছল ও সুখি জীবন। বসে বসে অন্ন ধংস না করে বরং নিজের রোজগারে নিজের পরিবার নিয়ে সুন্দর ও সাধারণ জীবন গঠন করে তার পেশাগত শিক্ষা এবং কর্মের সমন্বয়ে দৈনিক শিক্ষার ওপর বেস্ট প্রাকটিস করে চলছে।

সে তার পেশাগত কাজের আগে এবং পরের সময়টুকু ব্যবহার করে চলছে কীভাবে এলাকার শিক্ষাকে আরও তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া যায়। তার জন্য সে গ্রামের অবহেলিত ও অসহায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে ক্লাসের পাশাপাশি আলাদাভাবে ক্লাস করিয়ে তাদের শিক্ষার ক্রমোন্নয়ন করছে। সে বিনা বেতনে এসব শিক্ষার্থীদের পড়াতে এগিয়ে এসেছে এবং অনুপ্রেরণা করছে অন্যকেও। স্বার্থপরতার এই যুগে এমন বড় মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। বর্তমান সময়ে যেখানে দেশে কোচিং বাণিজ্যের রমরমা চলছে সেখানে এমন স্বার্থত্যাগী মানুষ পাওয়া একটু কঠিনই বটে! এলাকার মানুষ শিক্ষিত হোক, তাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক সভ্যতার সবটুকু আলো-এটা তার বহুদিনের স্বপ্ন। যে সমস্ত ছেলে-মেয়ে একটা সময় পড়াশোনার প্রতি ছিল পুরোপুরি উদাসীন, আজ তারা কোন্ মন্ত্রবলে শিক্ষার প্রতি এমন আগ্রহী হয়ে উঠল! এখানেই শাহজাহান মিয়ার কৃতিত্ব। সে কচি কচি শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার চেতনা জ্বেলে দিয়েছে। আঁধারের মাঝে সে আলোর মশাল হাতে করে এসেছে, ফলে অজ্ঞতার

আঁধার কেটে যেতে শুরু করেছে। হয়ত এই মশাল একদিন পুরো এলাকাকে আলোকিত করে তুলবে। 
গ্রামে যে ভালো শিক্ষা এবং শিক্ষকের সংকট নেই তা নয়, তার পরও সে তো সেই গ্রাম থেকেই তার প্রাথমিক লেখাপড়া শেষে ঢাকাতে পড়েছে! তাহলে কি বর্তমান শিক্ষার বা শিক্ষা পদ্ধতির অবনতি হতে শুরু করেছে? নাকি শিক্ষাঙ্গন দুর্নীতি ঢোকার কারণে এমন অধঃপতন? যাই হোক না কেন, যে বিষয়টি তার নজরে পড়েছে, আর সবাই যারা তার মত গ্রামে বসবাস করছে তাদের চোখে কেন ধরা পড়ছে না! আমার প্রশ্ন? দেশের আবহাওয়া কি সবাইকে অনেক বেশি অমানবিক করে তুলছে? 

যাই হোক তার থেকে অন্যের এই বিরাট পার্থক্যের কারণ তাহলে কী? কারণ হতে পারে একটাই তাহলো হাজারো সমস্যা তাদের বাধ্য করেছে মনের দুয়ার বন্ধ করে রাখতে। 
কয়েকদিন আগে দেখলাম শাহজাহান রক্ত দান করছে এবং অন্যকে উৎসাহিত করছে। সে বাঙালির ঐতিহ্য ধরে রাখতে পোলো দিয়ে মাছ ধরার আয়োজন থেকে শুরু করে মাদক সেবন থেকে নতুন প্রজন্মকে দূরে থাকার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানে সাহায্য করছে। সারাদিন পরিশ্রমের পরও একজন মানুষ যখন সমাজের আর দশজনের জন্য চিন্তা করে, এলাকার শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে ভাবে, তখন তাকে একজন মহান মানুষ হিসেবে অভিহিত করলেও হয়ত খুব বেশি বলা হয়ে যাবে না। যারা সত্যিকারের ভালো মানুষ তারা হয়ত এমনই হয়!

দেশের প্রতিটি গ্রামে যদি তার মত হাজারো মানুষের দৈনিক শিক্ষার প্রতিফলন হয় তাহলে অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করা এবং ধর্ম, গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করা একই সাথে ভণ্ডামি ও অনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ ও জাতির খেদমত করা সম্ভব। আমাদের প্রতিদিনের সেই কমিটমেন্ট যা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। শাহজাহান কি তাহলে তার এই প্রতিশ্রুতির ওপর দৈনিক শিক্ষার বেস্ট প্র্যাকটিস করে চলছে? একই সাথে সে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে প্রতিটি পদক্ষেপে এমনটি আচারণ করে চলছে! যাই হোক না কেন শাহজাহানের মত কোটি কোটি প্রজন্মের দরকার যারা শুধু পুথিগত বিদ্যার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে, দৈনিক শিক্ষার বেস্ট প্রাকটিসের সমন্বয় ঘটিয়ে সুশিক্ষার জন্য কাজ করেছে, যা নিঃসন্দেহে কুসংস্কার এবং কুশিক্ষাকে দূর করতে সক্ষম হবে। তাই সোনার বাংলায় কোটি কোটি শাহজাহান মিয়াকে দেখতে চাই। অরাজকতা, কুশিক্ষা ও দুর্নীতি ধ্বংস হোক, মানবতা এবং দৈনিক শিক্ষার জয় হোক।


লেখক : সুইডেন প্রবাসী


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003242015838623