বই নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো না কলেজছাত্রী ইয়াসমিনের। ভাগ্নিকে বাঁচাতে মামার প্রস্তুতকৃত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে উঠার আগেই চিরবিদায় নিলেন তিনি। অপহরণ করে ধর্ষণে কলেজছাত্রীর মৃত্যু ঘটনায় প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বইছে নেত্রকোনায়।
বই কিনতে এসে জন্ম নিল আরেক ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুনসী। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে নিহত ইয়াসমিনের মা নাছিমা খাতুনকে মেয়ের হত্যাকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পূর্বধলা থানার ওসি মোহাম্মদ তাওহীদুর রহমান, পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান, মামলার তদন্তকারী অফিসার এসআই আব্দুর রাজ্জাক। পুলিশ সূত্র জানায়, নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার খামারহাটি (কোনাপাড়া) গ্রামের মো. খোরশেদ আলীর কন্যা ইয়াসমিন আক্তার (২২) বই কিনতে ২১ আগস্ট সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে শ্যামগঞ্জে আসেন। পুর্বধলা থানার জালশুকা কুমুদগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের গেটের সামনে এলে ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টায় অপহরণের শিকার ইয়াসমিন আক্তার (২২)।
তাকে নেত্রকোনা সদর উপজেলার শ্রীপুর বালী গ্রামের মৃত আবুল হাসেমের পুত্র মো. আলমগীর হোসেন (২৪) মোটরসাইকেলযোগে অপহরণ করে। কলেজছাত্রীকে ফুসলিয়ে বিয়েসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে অজ্ঞাতনামা ২-৩ জনের সহযোগিতায় ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার সদরের এক ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়।
সেখানে একাধিকবার জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হন কলেজছাত্রী। ধর্ষণে বাধা দেয়ায় ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
এদিকে ২১ আগস্ট বিকাল থেকেই মেয়ের সন্ধানে পরিবারের লোকজন আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করতে থাকেন। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে খবর পান আলমগীরের সঙ্গে ইয়াসমিন শ্যামগঞ্জ এলাকায় রয়েছে। খবর পেয়ে মা ছুটে আসেন। তাকে দেখেই শ্যামগঞ্জ রেলগেট এলাকায় কলেজছাত্রীকে ফেলে পালিয়ে যায় আলমগীর।
সেখান থেকে কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করে তার মা নাছিমা আক্তার ও তার মামা আবুল কালাম আজাদ নিয়ে যান নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে। বিস্তারিত ঘটনার বলার পর এক পর্যায়ে জ্ঞান হারান ইয়াসমিন। তারপর তাকে দ্রুত নিয়ে যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দুদিন লাইফ সার্পোটে রাখা হয়।
রোববার তার মামা আবুল কালাম আজাদ ঢাকায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত করেন এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। সেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তার আর উঠা হয়নি। সকাল ৮টা ৩০মিনিটে চলে যান না ফেরার দেশে।
ইয়াসমিন নেত্রকোনা আবু আব্বাছ ডিগ্রি কলেজের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।
এ ঘটনায় রোববার তার মা নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে পূর্বধলা থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ আলমগীর হোসেনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোর্পদ করে। সোমবার আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
তার মামা আবুল কালাম আজাদ জানান, পারিবারিক সম্পর্কের জের ধরেই আলমগীরের সঙ্গে ইয়াসমিনের পরিচয়। ইয়াসমিনের ফুফাতো ভাই গোলাম মোস্তফার চাচাতো ভাই হলো আলমগীর হোসেন। এ সম্পর্কের জের ধরে আত্মীয় বাড়িতে বেড়ানোর কথা বলে নিয়ে গেলে একাধিকবার জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। ধর্ষণে বাধা দেয়ার কারণেই আজ জীবন দিতে হলো ভাগ্নীর।
ইয়াসমিনের মৃত্যুর সংবাদ কলেজে পৌঁছার পর সহপাঠী ও শিক্ষকরাও ক্ষোভে ফুঁসছেন।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
অপরদিকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান নেত্রকোনা স্বাবলম্বীর মানবাধিকার কর্মী কোহিনূর বেগম। তিনি বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। একইসঙ্গে এ ধরনের ঘটনা পুনরায় যেন না ঘটে তার জন্য মেয়েদেরকেও সচেতন হতে হবে।
নাতনিকে হারিয়ে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন নানী নুরজাহান। নানা দুহাত উপরে তুলে নাতনির বিচার প্রার্থনা করেন মো. শামছ উদ্দিন। তিনি বলেন, ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। ধর্ষকেরও ফাঁসি চাই।
মেয়ের ছবি বুকে জড়িয়ে বার বার জ্ঞান হারান মা নাছিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের হত্যাকারীর ফাঁসি চাই, আর কিছু না।’
মা নাছিমা খাতুন বাঁশ-বেতের কাজ করে সংসার চালান। দুই পুত্র আর এক কন্যার সংসারে ইয়াসমিনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। ইয়াসমিনেরও স্বপ্ন ছিল একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার। সে লক্ষ্য পূরণে পড়ার পাশাপাশি বেসরকারি এনজিও সংস্থার আশার শিক্ষা কার্যক্রমে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন।
উল্লেখ্য, ২৪ বছর আগে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল ইয়াসমিন। তখন থেকেই এ দিনটি সারাদেশে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।