ননএমপিওদের এমপিও চাই

মুজম্মিল আলী |

আজকের লেখাটা মূলত ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে। তার আগে একটু ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে নেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ অভ্যাসটি যে কাউকেই পেয়ে বসে। আমার বেলায়ও হয়েছে তাই। এ জন্য সুহৃদ পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে লেখাটা শুরু করা সমীচীন মনে করি। ছোটবেলায় মক্তব কিংবা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে শিক্ষকদের শাস্তি নিয়ে মায়ের কাছে অনুযোগ করলে মা হেসে বলতেন, শরীরের যে জায়গায় শিক্ষক মেরেছেন সে জায়গাটি বেহেশতে যাবে। অন্য বড়দের মুখেও কথাটি অনেক বার শুনেছি। শিক্ষকদের শাস্তি দেবার অধিকার আজ আর নেই।

এক আধটু ধমক দিলে শিক্ষককে উল্টো অভিযোগের রোষানলে পড়তে হয়। শিক্ষককে তাই শ্রেণি কক্ষে সাবধানে সতর্কভাবে কথা বলতে হয়। এখন নানা ঢঙে চুল ছেঁটে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে। আমরা তো চুল একটু লম্বা হলেই শিক্ষকের ভয়ে ক্লাসে যেতে সাহস পেতাম না। আজকাল প্রাইমারি স্কুলের ছোট ছেলেগুলোও তাদের শিক্ষকদের  সমীহ করে বলে মনে হয় না। আমাদের সময় শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও ভয় দু'টোই ছিল। আজ কোনোটিই নেই। সন্তানের অভিভাবক শিক্ষককে সম্মান দিতে চান না। শিক্ষার্থী সম্মান দিতে শিখবে কার কাছে? রাষ্ট্র আইন করে শিক্ষকদের শাস্তি দেবার অধিকার রহিত করেছে।

শিক্ষক ছাত্রকে মানুষ করার জন্য শাস্তি দেবেন কোন সাহসে? তাই শিক্ষা এখন শিকেয় চড়ে বসতে শুরু করেছে। ইদানিং শ্রেণি কক্ষে শিক্ষক অসহায় বোধ করেন। একজন অসহায় শিক্ষক কতখানি আত্মবিশ্বাস নিয়ে শ্রেণিতে পাঠদান করতে পারেন সে নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। আমাদের দেশের মতো আর কোথাও অসহায়ত্ব নিয়ে শিক্ষক ক্লাসে যান কিনা আমার জানা নেই। কেবল আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান একজন শিক্ষকই শ্রেণিতে যথার্থ পাঠদানে সক্ষম- সে সত্যটি সকলকে অনুধাবন করতে হবে।

আমাদের দেশে বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা অর্জনের সুযোগ কতটুকু আছে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। খেয়ে পরে ভালো করে জীবন-যাপন করার নিশ্চয়তা না থাকলে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা আসমান থেকে আসে না। ননএমপিও শিক্ষকদের বেলায় এ কথাটি বেশি প্রযোজ্য। তারা বেশি অসহায় বলে অন্তত আমার কাছে মনে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীকে চিনি। অনেক ননএমপিও প্রতিষ্ঠানের কথা জানি। আমি তাদের নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছি। এখনও লিখি। যতদিন তাদের এমপিও হবে না ততদিন লিখে যাব। নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই লিখে যাই।

ননএমপিও শিক্ষকদের প্রতি আমাদের সকলকে আরো মানবিক হতে হবে। বিনা বেতনে দুনিয়ার কোথাও কেউ কোনো কাজ করে বলে আজ পর্যন্ত শুনিনি। কেবল আমাদের দেশে ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের তাই করতে হয়। এক, দু'বছর নয়, অনেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে এভাবেই বিনা বেতনে শিক্ষাদানের মতো মহান ব্রতে নিয়োজিত রয়েছেন। তারা যে কত মানবেতর জীবন-যাপন করেন তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম কোনো এক ননএমপিও শিক্ষক স্কুল টাইমের পর স্থানীয় বাজারে শাক-সবজি বিক্রি করে নিজের সংসার চালান। আরেকজন স্কুল টাইমের পর রিক্সা চালিয়ে পরিবার পরিজনের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দেন। অন্য আরেকজন ঠেলাগাড়ি চালিয়ে সংসারের খরচ নির্বাহ করেন। জাতি হিসেবে আমাদের এ লজ্জার দায়ভার নিতে হবে। আমরা এ লজ্জা এড়িয়ে যেতে পারি না।

স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পর এ অবস্থা মেনে নেয়া যায় না। একজন কিংবা দু'জন নয়। লাখের ওপরে ননএমপিও শিক্ষক। ৯ থেকে ১০ হাজারের ওপরে ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সকলেই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এমপিওটি পাওয়া এখন ন্যায্য অধিকার। এ অধিকার পেতে তাদের কতবার রাজপথে নামতে হয়েছে। কোলের শিশু পিঠে নিয়ে ননএমপিও মা শিক্ষক রাজপথে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। অনশন করেছেন। আশ্বাসে বিশ্বাস করে বাড়ি ফিরেছেন। বিশ্বাস ভঙ্গে হতাশ হয়ে ফের রাজপথে সোচ্চার হয়েছেন। পুলিশের পিপার স্প্রে খেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়েছেন। তবু দাবির প্রতি অনড়। মিথ্যা আশ্বাসে আবারো বিশ্বাস রচনা করেছেন। কিন্তু কার কথা কে রাখে?

বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকগণও এমপিওর দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তাদেরও ন্যায়সঙ্গত দাবি এটি। যারা দাবিটি মানবে তাদের কানে কে যেন তুলো দিয়ে রেখেছে। তারা নির্বিকার। ঘুমের ঘোরে একেবারে অচেতন! শিক্ষক উপোসে মরলে তাদের কিছু যায় আসে না। আমলারা শিক্ষক সমাজের প্রতি এত নির্দয় হয় কেন, কে জানে? একজন নজরুল ইসলাম খানের মতো শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব সচিব শিক্ষকদের নসিবে জুটে না কেন? আসলে ভালো মানুষ ঘরে ঘরে জন্মায় না। প্রতিদিনও না। একজন ভালো মানুষ অনেকদিন পরে জন্ম নিয়ে থাকেন। একজন এন আই খানের জন্য শিক্ষক সমাজের তাই অনেক ভালবাসা।  

ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা আবারও রাজপথে। তারা প্রধানমন্ত্রীকে তাদের কষ্টের কথা জানাতে চান। একজন শেখ হাসিনার ওপর শিক্ষক সমাজের ভিন্ন এক আস্থা। অন্য এক বিশ্বাস। আর কাউকে তারা বিশ্বাস করেন না। সকলে তাদের ধোঁকা দিয়েছেন। এমপিও দেই দেই করে আজও দেয়নি। আমলাদের দেয়াল ভেদ করে তারা যদি তাদের দাবির কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছাতে পারেন, তবে তারা সফল হবেনই। আমলাদের দেয়াল তারা কতটুকু টপকাতে পারবেন কে জানে। এদের দেয়ালটা বড় শক্ত। বড় মজবুত। এটি ভেদ করে যে বার্তাটি প্রধানমন্ত্রীর কানে যায়, সেটি বাস্তবায়ন না হয়ে যায় না। ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের সে দেয়ালটি যে করে হোক টপকাতে হবে। আমরাও প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে অনুরোধ করব-দয়া করে সকল ননএমপিওকে অবিলম্বে এমপিও দিন। শেখ হাসিনার বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন নেই- এরচে' বেশি লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে? এ লজ্জা আমাদের সকলের।       

 
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030701160430908