নবম থেকে এসএসসি পর্যন্ত ঝরে পড়ছে পাঁচজনের একজন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি সরকারি স্কুলেও প্রতিবছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করেন, তার মধ্যে একটি বড় অংশ শেষ পর্যন্ত নানা কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। সারা বছর পড়ানোর পরও শিক্ষার্থীদের এমন ঝরে পরা নিয়ে হতাশ স্কুলটির একজন শিক্ষক তাসকিন জাহান।

উপবৃত্তিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বাড়লেও ঝরে পড়া কমছে না : ছবি সংগৃহীত

তিনি বলেন, ধরেন স্কুল থেকে রেজিস্ট্রেশন করেছে ১০০ জন। কিন্তু পরীক্ষা দিতে যায় ৭০ জনের মতো। মানে থার্টি পারসেন্ট স্টুডেন্ট বাদ পড়ে যাচ্ছে। সেটা আমাদের টিচারদের জন্যও মানসিক চাপ। কারণ আমরা চাই আমাদের প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট পরীক্ষার হলে বসুক। রোববার (১৯ জানুয়ারি) বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সানজানা চৌধুরী।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের সবশেষ মাধ্যমিক শিক্ষাবর্ষের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার বিষয়টি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের অপচয় এবং যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে জানা গেছে, দুই বছর আগে নবম শ্রেণিতে ২০ লাখ ৭৪ হাজার শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেছিল। কথা ছিল তারা সবাই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে এবার পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী বা প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন ঝরে পড়েছে।

রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়
প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর এই ঝরে পড়ার হারকে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় বলে উল্লেখ করে সরকারকে দ্রুত নজর দেয়ার কথা বলেছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।

তিনি বলেন, সরকারি তথ্য থেকেই বেরিয়ে আসছে যে, মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার লাগাম টানা যাচ্ছে না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সরকার শিক্ষার পেছনে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। তারপরও পাঁচজনের মধ্যে একজন ঝরে যাওয়া আমাদের জাতীয় পর্যায়ে বিনিয়োগের একটা বড় অপচয়। যা অবশ্যই উদ্বেগের।

ঝরে পড়ার কারণ কী
মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তারে সরকার বৃত্তি, উপবৃত্তি, বিনা মূল্যে বই ও খাবার সরবরাহসহ আরও নানা খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা করলেও শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঝরে পড়ার অন্যান্য কারণগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও জানান তিনি। তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে এই ঝরে পড়া নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে কিন্তু এ নিয়ে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি পর্যায়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে। তখন প্রকৃত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যাবে আর সেই মোতাবেক প্রতিকারের উপায় বের করা সহজ হবে।

তবে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে, সেখানে ঝরে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ওই শিক্ষার্থীদের পরিবার অবস্থা সম্পন্ন হয় না। তাদের পক্ষে এই শিক্ষার ব্যয় টেনে নেয়া কঠিন হয়ে যায়।

বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করা হলেও মাধ্যমিকের একটি বড় অংশই বেসরকারি। যেখানে পড়াশোনার খরচ বেশি। তাছাড়া মাধ্যমিকে বিভিন্ন কোচিং বা প্রাইভেট পড়ার খরচও আছে। সেটা অনেক পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে যায় বলে জানান রাশেদা কে চৌধুরী।

অর্থ উপার্জনের চাপ থাকায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থী : ছবি সংগৃহীত

ফলে একটা অংশ ঝরে যায়। তখন তারা বিভিন্ন দিকে রুটি রুজির সন্ধানে হারিয়ে যায়।

গাজীপুরের কালীগঞ্জের শিক্ষিকাও তার স্কুলে ঝরে পড়ার পেছনে এই উপার্জনের প্রতি ঝোঁক এবং এছাড়া উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহের অভাবকে কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের স্কুলের বাইরে একটা নতুন হোটেল হয়েছে। দেখা যায় যে অনেক স্টুডেন্ট স্কুল বাদ দিয়ে সেখানে কাজ করছে। আবার অনেক ছেলেরা বাড়িতে কৃষিকাজ করে। কারণ এই বয়সী অনেক ছেলেমেয়ের ওপর পরিবারের দায়িত্ব চলে আসে। পড়াশোনার প্রতি তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ওরা বুঝতে পারে না যে এসএসসি পাস করে তার জীবনে কী এমন পরিবর্তনই বা হবে

তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ নিরাপত্তাহীনতা, মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকের অভাব এবং স্কুলগুলোয় স্যানিটেশনের ব্যবস্থা না থাকা বলে জানান রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, স্কুলে যাওয়া আসার পথে এমনকি স্কুলের ভেতরে এই বয়সী মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে বাবা মা খুব উদ্বিগ্ন থাকে। অনেকে ইভটিজিং, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাছাড়া অনেক পরিবার মেয়ের পেছনে এতো খরচ করতে চায় না। তখন তারা মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখা বা বিয়ে দিয়ে দেয়াকেই সহজ সমাধান বলে মনে করে।

পরীক্ষায় অংশ না নেয়া মানে ঝরে পড়া নয়
তবে এই চার লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশ না নেয়াকে ঝরে পড়া বলতে চাইছেন না মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান মো. জিয়াউল হক। তাঁর মতে, গত এক দশকের তুলনায় মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ঝরে পড়ার এই সংখ্যাকে বেশি বলে মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, এটাকে ঝরে পড়া বলা যাবে না। তারা লেখাপড়ার সাইকেলের মধ্যেই আছে। হয়তো সে টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি বা অসুস্থ ছিল এজন্য এসএসসিতে অংশ নিতে পারেনি। হয়তো তারা আগামী বছর পরীক্ষা দেবে। এটা প্রতিবছরের চিত্র। একে অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

তিনি জানান, এক দশক আগেও যে পরিমাণ শিক্ষার্থী মাধ্যমিকে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতো, এখন সেই হার অনেকটাই কমে এসেছে। এবং প্রতিবছরই এই হার কমছে। তবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাতারাতি এই ঝরে পড়ার হার শূন্য পর্যায়ে নামিয়ে আনা রীতিমত অসম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তিতে যুক্ত সাড়ে ৮৮ শতাংশই জেএসসি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। তাই এই শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে সরকারের বিনিয়োগ নীতিমালায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড একে উদ্বেগের কিছু নেই বলে উল্লেখ করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সরকার শিক্ষা বিস্তারের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সেটা অধরাই থেকে যাবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066859722137451