নম্বরে পক্ষপাতের অভিযোগে জবি বাংলা বিভাগের ফল বাতিল

জবি প্রতিনিধি |

এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নম্বর দেয়ায় পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের একটি কোর্সের মিডটার্ম পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে তা পুনর্মূল্যায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের কাছে পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস

বাংলা বিভাগের ১৮ শিক্ষকের মধ্যে ১৬ জন উপাচার্যের কাছে মিডটার্ম পরীক্ষার নম্বরে পক্ষপাতের অভিযোগ করেছিলেন ৫১০১ কোর্সের শিক্ষক অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে।

গত অক্টোবরে বিভাগের ৩০ ও ৩১তম একাডেমিক কমিটির সভায় মিল্টন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নম্বরে অনিয়মসহ কয়েকটি অভিযোগ তুলেছিলেন শিক্ষকরা।

৩০ অক্টোবর মিল্টন বিশ্বাসের সব কোর্সের নম্বর পুনর্মূল্যায়নের জন্য উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন শিক্ষার্থীরাও। পরদিন মাস্টার্স দ্বিতীয় সেমিস্টারের মিডটার্ম পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাসে আন্দোলনেও নামেন তারা।

বাংলা বিভাগের শিক্ষকরা অনিয়মের অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। তবে মিল্টন বিশ্বাস তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মিল্টন বিশ্বাস এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময়ও নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর শাস্তি পেয়েছিলেন। 

মিল্টন বিশ্বাসকে পদাবনতি দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তমিল্টন বিশ্বাসকে পদাবনতি দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪২তম সিন্ডিকেট সভায় মিল্টন বিশ্বাসকে সহকারী অধ্যাপক থেকে প্রভাষক পদে পদাবনতি দেয়া হয়েছিল। ১০ বছরের জন্য পরীক্ষা সংক্রান্ত সব কাজ থেকে তাকে বিরত রাখা এবং পরবর্তী তিন বছর পদোন্নতির আবেদন বিবেচনা না করার সিদ্ধান্তও দিয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।

তখন মিল্টন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি তার ঘনিষ্ঠ এক শিক্ষার্থীর উত্তরপত্রের উপরের অংশ খুলে নিজের লেখা খাতার উপরে বসিয়ে দিয়েছিলেন।

মিল্টন বিশ্বাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে নিয়োগ পান ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের পরিচালকের দায়িত্বও পান।

জগন্নাথের বাংলা বিভাগের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক চঞ্চল কুমার বোস বলেন, “পছন্দের তিনজনকে ১০ এ ১০ দিয়েছে। ৩ দিয়েছে একাধিকজনকে, যারা অপছন্দের। সে (মিল্টন বিশ্বাস) একাডেমিক কাজে অসহযোগিতা করে, নম্বর হারিয়ে ফেলে, পরীক্ষা কমিটির কাজে কোনো মনোযোগ নাই। 

“এক মেয়েকে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়েছিল, তা আমরা মীমাংসা করেছিলাম একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে। এ পরীক্ষায় তাকেসহ তার সাথে যারা মিশে, তাদেরও ৩ দিয়েছে।”

অধ্যাপক চঞ্চল বলেন, “তিনি একাডেমিক কাজে দুর্নীতি করেছেন, আমরা এর বিচার চাই। উপাচার্যকে আমরা একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে জানিয়েছি। একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে নম্বরের বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার হাতে নম্বর আছে তাই দিয়েছি’।”

বাংলা বিভাগের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আরজুমন্দ আরা বানু বলেন, “নম্বর দেয়ায় তিনি বৈষম্য করেছেন। এটা একাডেমিক কমিটিতে উঠে। আরও এরকম কোনো কোর্সে হয়েছে কি না, সেটা দেখতে অন্যান্য কোর্সের শিক্ষকদের নম্বরও দেখেছি, শুধু উনার কোর্সেই এরকম পেয়েছি। তখন একটা প্রশ্ন দাঁড়ায় এবং মাস্টার্সের রেজাল্ট নিয়েই আমাদের শিক্ষার্থীদের ফেইস করতে হয়, সেজন্যই আমরা ভিসি স্যারকে জানাই।

“উনাকে সবসময় আমার তাগাদা দিতে হয় প্রশ্ন সময়মতো দিতে। ফার্স্ট ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারেও উনার কোর্সের পরীক্ষা পিছিয়েছিল, সময়মতো প্রশ্ন না দেয়ায়। একাডেমিক কোনো কাজেই উনার মনোযোগ নেই।”

মিল্টন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী স্নিগ্ধ স্মরণ বলেন, “উনার বিরুদ্ধে ওঠা কোনো অভিযোগই মিথ্যা না। ১০/১৫ মিনিটের বেশি ক্লাস নেন না। বলে বেড়ান, ‘আমি ১০ মিনিটের বেশি ক্লাস নেব না, যদি কারও কিছু করার থাকে, করুক’।

“প্রত্যেক ব্যাচেই তার কয়েকজন শিষ্য থাকে, তাদের পরীক্ষার আগে প্রশ্ন বলে দেয়। কখনোই মিডটার্মের ফল প্রকাশ করে না। সব ক্লাস করে না, এমন চাকরিজীবীকেও এটেনডেন্সে ১০ দিয়েছেন। ওকে দিয়ে তিনি বিভিন্ন কাজ করান।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “আমি মাস্টার্স ১ম সেমিস্টারে উনার সব ক্লাস ও মিডটার্মে অংশ নিয়েছি। তারপরও মিডটার্মে তিনি আমাকে অনুপস্থিত দেখিয়েছেন, এটেনডেন্স নম্বরও দেননি। পরীক্ষার খাতাও তিনি নিজে দেখেন না, অষ্টম ব্যাচের হাবিব আহসান দেখে। তিনি শিক্ষার্থীদের গালি ছাড়া কথা বলেন না।”

সাবেক শিক্ষার্থী হাবিব আহসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিজেকে মিল্টন বিশ্বাসের ‘খুব ঘনিষ্ঠ ছাত্র’ বলে দাবি করেন।

মিল্টন বিশ্বাস নিজেই খাতা দেখেন দাবি করে হাবিব বলেন, “যারা নম্বর পেয়েছে, তারা মেধার ভিত্তিতে পেয়েছে। ভিসি স্যার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে খাতা পাঠিয়েছে মূল্যায়নের জন্য। এরপরও চঞ্চল স্যার আগের নম্বর বোর্ডে টানিয়ে দিয়েছে। এভাবে শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়ে দু’চারজন শিক্ষক মাঠে নামিয়েছে।”

কারা উস্কানি দিয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভিসির কয়েকজন শিক্ষক।”

গত ৪ নভেম্বর বিভাগে গিয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস বলেন, “আমি কলাম লেখার কাজে ব্যস্ত। এখন কথা বলতে পারব না, পরে আসেন। এখন এটা আর নিউজ করার বিষয় না, মামলার পর্যায়ে আছে। কোর্টে সব হবে। তারপর আসামি হবে আরও। এখন যারা টার্গেট, তাদের ছাড়াও আরও কিছু আসামি বাড়বে।

“এখন নিউজ করার কিছু নেই। এখন শুধু মামলা হলে, আসামি হলে, গ্রেফতার হলে তখন নিউজ হবে। মামলা হলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হবে।”

পরে ফোনে বক্তব্য জানতে চাইলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

গত ২৯ অক্টোবর অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস অধ্যাপক চঞ্চল কুমার বোস ও হোসনে আরা জলিকে আইনি নোটিশ পাঠান। তার অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে আলোচ্য বিষয় ছাড়াই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

এর আগে ২০ অক্টোবর অধ্যাপক আরজুমন্দ আরা বানুকেও আইনি নোটিশ দেন তিনি।

গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত শিক্ষকদের সংবাদ সম্মেলনে লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রিতু কুন্ডুও অভিযোগ তুলেছিলেন মিল্টন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মিরপুরগামী শিক্ষকদের বাসে নারী শিক্ষিকদের সঙ্গেও মিল্টন বিশ্বাস ‘অশোভন আচরণ’ করেন। বাংলা বিভাগের একজন নারী শিক্ষক তার ‘অশোভন আচরণে’ বাস থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন।

রিতু বলেন, “উনার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলন শুরু করে, তখন আমি ফেইসবুকে ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ গ্রুপে উনার এসব আচরণ নিয়ে পোস্ট করেছিলাম। এজন্য তিনি আমাকে উকিল নোটিশ দিয়েছেন।”

সহকর্মীদের পাঠানো আইনি নোটিশে মিল্টন বিশ্বাস দাবি করেন, বাংলা বিভাগে তার চেয়ারম্যান হওয়া আটকাতে ওই শিক্ষকরা তার বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’ নেমেছেন।

মিল্টন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, “ওই খাতার নম্বর বাতিল করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এক্সপার্টকে দিয়ে খাতা দেখানো হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, “এ ব্যাপারে আমি তদারকি করছি।”

গত ৭ নভেম্বর রেজিস্ট্রার ওহিদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশের মাধ্যমে মিল্টন বিশ্বাসকে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। পরে তিনি এক চিঠির মাধ্যমে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ না করার কথা জানান প্রশাসনকে। পরে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা হয় অধ্যাপক পারভীন আক্তার জেমীকে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ওহিদুজ্জামান বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে আছে, একই সঙ্গে দুটি দায়িত্ব পালন করা যাবে না। উনি বর্তমানে জনসংযোগ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন, উনাকে আমরা একটা অপশন দিয়েছিলাম; উনি যেটা গ্রহণ করতে চান সেটাই করবেন। নোটিশ পাওয়ার পরপরই চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, এখন তিনি চেয়ারম্যানশিপের দায়িত্ব নিতে চান না।”


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028119087219238