‘রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিক্ষা’—একটির সঙ্গে অন্যটি অত্যন্ত অপরিহার্যভাবে জড়িত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে সুস্থ রাজনীতির চর্চা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। শুধু অপরাজনীতি ও দুঃশাসনের কারণে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল প্রায় ৪৩ বছর। সেই ধারাকে ঘুরিয়ে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। অসম্ভবটি সম্ভব হয়েছে সুস্থ রাজনীতির চর্চা ও জনগণের সার্বিক শিক্ষার মানোন্নয়নের কারণে। আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা, যা বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই ঈর্ষার কারণ। তার পরও টেকসই উন্নয়ন বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশ তা থেকে এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে আছে বলেই আমার ধারণা। টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব হয়, যখন একটি দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অনগ্রসর অংশটি সার্বিক উন্নয়ন ও উৎপাদনে অংশ নেয়। বাংলাদেশের পটভূমিতে অনুন্নয়ন অংশটি বলতে মূলত মোট জনসংখ্যার অর্ধেক বা তারও বেশি নারীসমাজকে বোঝায়, যারা জাতীয় উৎপাদনে শতভাগ অংশ নিতে পারছে না বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে, যদিও বর্তমান সরকারের এ ব্যাপারে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। নারীর উন্নয়নকল্পে নারীর ক্ষমতায়নকে আলাদাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং এ দুটি বিষয়ই পরস্পরের পরিপূরক বলে পরিগণিত হওয়া উচিত।
দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় দুই দশকের অধিককাল ধরে প্রধান এই রাজনৈতিক দলটির প্রধান হচ্ছেন একজন নারী। দীর্ঘ সময় ধরে দল ও রাষ্ট্রের প্রধান একজন নারী হলেও রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে আনুপাতিক হারে নারীর ক্ষমতায়নের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। রাষ্ট্রের কথা বাদ দিলেও রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। অথচ ২০০৮ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের আদেশ অনুযায়ী আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বস্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব হতে হবে ৩৩ শতাংশ, যা বর্তমানের বাস্তবতায় সুদূরপরাহত। একাত্তরে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে একজন নারী থাকা সত্ত্বেও সেই দল রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের সুস্পষ্ট কোনো ছাপ রাখতে না পারাটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে বৈকি। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যে নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা, তা এই দলেও অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে দেখা যায়। এ ছাড়া দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায়ও সংখ্যানুপাতে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই বললেই চলে। প্রশিক্ষিত নারী নেতৃত্ব তৈরি করতে যে রাজনৈতিক শিক্ষা ও পরিবেশের দরকার হয়, সে ব্যাপারেও আগ্রহ ও উদ্যোগের প্রচণ্ড অভাব পরিলক্ষিত হয় প্রায় সর্বস্তরে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যাতে সমানভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুযোগ পায়, সেই পরিবেশ তৈরির কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দরকার হয় তার সুনিশ্চয়তা দিতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের অগ্রাধিকার দেখা যায় প্রায় সর্বক্ষেত্রে, যা নারীদের অবদমিত করারই নামান্তর। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন রাখার অধ্যাদেশটি প্রত্যক্ষভাবেই প্রমাণ করে রাজনীতিতে নারীর সংখ্যালঘুতা ও অবমূল্যায়নের কথা। পুরুষের পাশাপাশি নারীর সিদ্ধান্তগ্রহণমূলক যে শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা খুবই কম বা নেই বললেই চলে। এ অভাব দূর করতে হলে নারী নেতৃত্ব তৈরির কোনো বিকল্প নেই এবং তা করতে হবে নারীর ছাত্রজীবন থেকেই।
‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দটি শুনতে খুব চমকপ্রদ হলেও এর সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায় না এবং এককথায় সংজ্ঞায়ন করাও সম্ভব হয় না। বিশ্বে এমন দেশও আছে, যেখানে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দটিই নেই। নারীর ক্ষমতায়ন কথাটি মোটাদাগে লিঙ্গসমতাকে বুঝিয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতাবিন্যাসে নারীর অবস্থানকে তুলে ধরতে এই পরিভাষার ব্যবহার হতে দেখা যায়, যা মূলত ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং নারীশিক্ষা’ বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীভূত করে। বিশ্বব্যাংক ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দটিকে সরলীকরণের প্রয়াসে বলেছে এভাবে যে ‘ক্ষমতায়ন হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পছন্দগুলোকে যাচাই-বাছাই করে আলাদা করার পর প্রাপ্ত ফলাফলকে কর্মে রূপান্তরিত করে সেগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।’ বাংলাদেশে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ প্রক্রিয়াটি ধীরগতিতে হলেও এগিয়ে চলছে, যা বিশ্বের সমীহ আদায়ে সমর্থ হচ্ছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা ও একনিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা শুরু করেছিল তখন তাঁর মাথার ওপরে ছিল পূর্ববর্তী জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের রেখে যাওয়া একটি ছিন্নভিন্ন হতদরিদ্র দেশ। সেই দেশের দায়ভার বহন করা নিঃসন্দেহে হাসিনা সরকারের জন্য সহজ ছিল না; বরং সর্বক্ষেত্রেই ছিল প্রতিবন্ধকতা, শত্রুতা আর অসহযোগিতা। সে অবস্থা থেকে দেশকে ঘুরিয়ে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করেছেন শেখ হাসিনা। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ আজ একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে বিশ্বদরবারে।
বিশ্বকে মোকাবেলা করতে বাংলাদেশ সব সেক্টরে যে সফলতা অর্জন করছে, ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষমাণ বিশ্বমানের নারী নেতৃত্ব তৈরিতে ততটা ব্যর্থ হচ্ছে বলেই মনে হয়। নারী নেতৃত্বের জন্য যে রাজনৈতিক শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দরকার হয়, বাংলাদেশের কোনো নারীই তার সুষম সুযোগ পায় না। ছাত্ররাজনীতি থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যাঁরা, তাঁরাই হন জাতীয় নেতা, যার প্রায় সর্বক্ষেত্রেই নারী থাকে দ্বিতীয় বা তারও নিচের কাতারে। রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ নেতৃত্বের ‘তল্পীবাহক’ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তৈরি করতে প্রয়োজন শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নারী নেত্রী তৈরি করা।
আজ ১১ ও কাল ১২ মে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় কাউন্সিল। আমার জানামতে, ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আজ পর্যন্ত কোনো নারী নেতৃত্ব আসেনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব তৈরি হয় ছাত্রলীগেই। আধুনিক বাংলাদেশের ছাত্রলীগে দেখেছি অনেক চৌকস নারী নেত্রী। এ ছাড়া দেখেছি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির অনেককে, যাঁদের দেশপ্রেম, নেত্রীর প্রতি একনিষ্ঠতা ও সংগঠনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার প্রগাঢ়তা। বিশ্বকে মোকাবেলা করতে যে নারী নেতৃত্বের কথা আমরা ভাবি, তা তাঁদের মতো নেত্রীদের মধ্যে বিদ্যমান। সনাতন প্রথাকে ভেঙে ছাত্রলীগে তৈরি হোক নারী নেতৃত্ব। এতে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হবে—ঋদ্ধ হবে ছাত্রলীগ।
লেখক : সুইডেনপ্রবাসী সাংবাদিক
সূত্র: কালের কণ্ঠ