যৌন হয়রানির দায়ে ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত নালিশ করেছিলেন ওসির কাছে, কিন্তু ওসি তাতে কান দেননি। দুই সাবেক স্ত্রী ও এক নারী সহকর্মী পৃথক ঘটনায় প্রতারণা, ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানি ও হত্যার হুমকির অভিযোগ এনেছেন এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে, তাতেও দীর্ঘদিন কান দেয়া হয়নি। গত ২৪শে নভেম্বর শিক্ষা ক্যাডারের অভিযুক্ত ওই সদস্যকে সবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আদালতে দায়ের করা মামলা, ব্লাস্টে দাখিল করা অভিযোগসহ বিভিন্ন নথি পর্যালোচনায় ওই চিত্র ফুটে উঠেছে। জানা গেছে, বরখাস্ত হওয়ার পরে অভিযুক্ত শিক্ষক তার সরকারি স্কুল শিক্ষিকা সাবেক দ্বিতীয় স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করিয়ে বরখাস্ত করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এই শিক্ষিকা গত সপ্তাহে শাহবাগ থানার ওসির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ওসির। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার নাম আবদুর রাজ্জাক। আজ ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত এক সংবাদে এ তথ্য জানা যায়। বিস্তারিত পড়ুন:
রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অধিকাংশই পুলিশি তদন্তে প্রমাণিত হয় দু’ বছর আগেই। কিন্তু এর ফল হিসেবে জামিনে থাকা ওই শিক্ষা ক্যাডার সদস্যকে সবেমাত্র ‘‘সাময়িকভাবে বরখাস্ত’’ করা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের কোনো তোড়জোড় নেই। অনেকে মনে করেন ‘মন্ত্রীর ভাতিজা’ পরিচয়দানকারী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আসলে একটি আইওয়াশমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সেকারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) নারীর প্রতি কতোটা সংবেদনশীল, সেই প্রশ্ন বড় আকারে উঠেছে।
আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষিকার করা যৌতুক মামলায় শিক্ষা ভবনের প্রকল্প কর্মকর্তা বরখাস্ত
নারীর বিরুদ্ধে লাগাতার সহিংস মনোভাব দেখানোর এই কাহিনীর দৃশ্যত খলনায়ক একডজনের মতো মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করেন। তার বক্তব্য নেয়ার জন্য তার ফেসবুকসূত্রে উদ্ধার করা মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। বিসিএস ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষক রাজ্জাক প্রেম করে প্রথম বিয়ে করেছিলেন । মেয়েটির পরিবার দরিদ্র ঘরের বেকার ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি। তখন তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মেয়েটি তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে দুর্বল হন। পরে তার মাশুল তাকে চরমভাবে দিতে হয়েছে। দুবছরও সে বিয়ে টেকেনি। কিন্তু ব্লাস্টে দায়ের করা অভিযোগের বিবরণে প্রকাশ, রাজ্জাক তার প্রথম স্ত্রীকে চরমভাবে দৈহিক নির্যাতন করেছেন। একটি পারিবারিক সূত্রের দাবি, রাজ্জাকের প্রচণ্ড নির্যাতনে মেয়েটিকে আজো নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হয়। এমনকি তিনি সন্তান ধারণের ক্ষমতা চিরতরে হারিয়েছেন। আদালতের ডিক্রি অনুযায়ী খোরপোষ ইত্যাদির টাকা রাজ্জাক সরকারি কোষাগারে জমা দেন। কিন্তু বহু বছর কেটে গেলেও তিনি আর সেই অর্থ তুলেননি। ওই সূত্রের মতে মেয়েটির দ্বিতীয় স্বামী সজ্জন, তিনি স্ত্রীকে ভালোবাসেন। অতীত নিয়ে তাকে বিব্রত করেন না।
ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো অবশ্য বলেছেন, রাজ্জাকের মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে তার ভালো আচরণেরও নজির মেলে। তিনি ক্লাসে পড়ান ভালো। প্রথম বিয়ে ও তাকে তালাক দেয়ার বিষয় গোপন করে ছাত্রীকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ে ফাঁস হওয়ার মাত্র সাড়ে চার মাসের মাথায় পুনরায় তালাকপ্রাপ্ত হন। এরপর তিনি সাবেক ছাত্রী টার্নড সাবেক স্ত্রীকে ‘‘নুসরাতের ভাগ্য’’ বরণ করানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালান বলেই অভিযোগের বিবরণে প্রকাশ। দ্বিতীয় স্ত্রীর স্কুলে গেলে তার জ্ঞাতসারেই ভিডিও করা হয়। ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, মাউশির ডিজি তার কিছুই করতে পারবেন না।
ফেনীর নুসরাতের সঙ্গে এই ঘটনার তফাৎ হলো পুলিশ প্রশাসন ‘‘নারী’’ বলে বাদিনীকে বিমুখ করেনি। বরং সংশ্লিষ্ট পুলিশ দ্রুত তদন্ত করেছে। পুলিশ আদালতে অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তি চেয়েছে। কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর মাউশি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই অসংবেদনশীল ভূমিকা রেখেছে। একজন আবদুর রাজ্জাক পুলিশ, আদালতের পরোয়ানা এবং সম্ভাব্য বিভাগীয় ফৌজদারি মামলা কী করে এত দীর্ঘ সময় ঠেকিয়ে রেখেছেন, তার তদন্ত দরকার বলে ওয়াকিবহাল মহল জোরালো মত দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ৩৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের পাহাড় জমেছে। তিনি জামিনে বেরিয়ে তার সরকারি স্কুল শিক্ষিকা সাবেক স্ত্রীকে দলবল নিয়ে প্রকাশ্যে অপহরণের চেষ্টা করেন। র্যাবের হাতে ধরা পড়েন। র্যাবের এক কর্মকর্তার ভাষায়- লোকটি তার আচরণের জন্য ‘অনুতপ্ত’ হন। মৌখিক মুচলেকায় ছাড়া পান। কিন্তু এরপর গ্রামের কলেজ থেকে বদলি হয়ে খোদ রাজধানীতেই একটি বড় কলেজ শিক্ষা প্রকল্পে তিনি জেঁকে বসেন। এবং ফেসবুকে তার সাবেক দ্বিতীয় স্ত্রী, যিনি ইতিমধ্যে অপর এক নন ক্যাডার শিক্ষককে বিয়ে করেছেন, তাদের দাম্পত্য জীবনকে দুর্বিষহ করতে প্রচারণা শুরু করেন।
দৃশ্যপট ১:
৮ই মার্চ ২০১৮। মানিকগঞ্জের একটি সরকারি কলেজ। মাউশির তৎকালীন মহাপরিচালকের কাছে মানহানির প্রতিকার চেয়ে একটি আবেদন করেছিলেন। এতে বলা হয়, আমি একজন নারী প্রভাষক। ৩৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। হাতেলেখা আবেদনে তিনি মাউশি ডিজি’র কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘ফেসবুকের বিষয় নিয়ে কোনো নারী কলিগের কলেজে ফোন দিয়ে তার মানহানি করার চেষ্টা করাটা কতখানি যৌক্তিক? এই জঘন্য কাজটি করেছেন ৩৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক, প্রভাষক, সরকারি সফর আলী কলেজ, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।’
ওই শিক্ষিকা লিখেন, ফেসবুক গ্রুপের এডমিন নিয়ে ৩৪তম বিসিএস ক্যাডাররা তর্কে জড়ান। এই ঘটনায় রাজ্জাক আমাকে ফোন দিয়ে ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন। সে বলে যে, সে মন্ত্রীর ভাতিজা, আমাকে সে দেখে নিবে। প্রফেসর দেওয়ান হাফিজ উদ্দিন ছিলেন তখন প্রিন্সিপাল। তাকে ফোন দিয়ে এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে। রাজ্জাক ২৫ জন কর্মকর্তাকে নিয়ে একটা ফোরাম গঠনের চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই শিক্ষিকা এর বিরোধিতা করেন এই বলে যে, ৩৪তম বিসিএস-এ ৭৯৯ জন শিক্ষক। তাই ২৫ জন দিয়ে ফোরাম গঠন কখনোই কাম্য নয়। বিষয়টি প্রকাশ পেলে রাজ্জাক আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলশ্রুতিতে আমি এখন আমার নিজের ভার্সিটি ক্যাম্পাসে চলাফেরা করাই নিরাপদ মনে করছিলাম না। আবদুর রাজ্জাক ফোনে যেভাবে আমাকে ধমকিয়েছেন তাতে বুঝা যায়, তিনি কোনো নারীকে সম্মান দিতে জানেন না।
ওই শিক্ষিকার চিঠি প্রমাণ করে যে, মাউশি ডিজি রাজ্জাকের দ্বারা স্ত্রী নিগ্রহের বিষয়টি ওই শিক্ষিকার দ্বারাও অবহিত হয়েছিলেন। কারণ তিনি ডিজিকে লিখেছিলেন, রাজ্জাকের স্ত্রীর কাহিনী শুনে কারো ‘চোখে পানি এসে যাওয়া খুব স্বাভাবিক।’ তার প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকা সাবেক স্ত্রী ৪ঠা আগস্ট, ২০১৭ তারাই ইনবক্সে কিছু কথা লিখেছিলেন। যা পড়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মাউশি ডিজিকে অনুরোধ করেছিলেন ওই ক্যাডার প্রভাষক।
উল্লেখ্য, পুলিশের তদন্তে পরিষ্কার যে, ৩৪তম বিসিএস’র ক্যাডার ফোরামের সভাপতি হতে রাজ্জাক ফেসবুকে প্রচারণা চালান। এতে তিনি তার ০১৭১৫-৩৪৭৭৭৭ নম্বরটি ব্যবহার করেন। পরে পুলিশ বলেছে, এই নম্বরটি দিয়েও রাজ্জাক তার সাবেক স্ত্রীকে হুমকি দিয়েছেন।
দৃশ্যপট-২:
২০১৯ সালের ১০ই আগস্ট মাউশি ডিজিকে লেখা চিঠিতে বলা হয়, আমি রুবিনা (ছদ্মনাম)। টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানায় আমার বাড়ি। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। যখন কলেজছাত্রী ছিলাম, তখন প্রভাষক রাজ্জাক তার আগের বিয়ের তথ্য গোপন করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বাবা-মায়ের সম্মতিতে ২০১৭ সালের ১০ই মার্চ রাজ্জাকের সঙ্গে বিয়ে হলো। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই যৌতুক দাবি করলেন। শুরু হলো মানসিক ও শারীরিক পীড়ন। এরমধ্যে একদিন তার বন্ধুর মুখে তার বেড়া থানার লায়লার (ছদ্মনাম) আগের বিয়ের তথ্য জেনে ভেঙে পড়ি। জানতে পারি, রাজ্জাক পাবনা জেলার বেড়া থানার মো. রিয়াজ উদ্দিনের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। সেই বিয়ে হয় ২০০৮ সালের ১১ই এপ্রিল। যৌতুকের জন্য মারপিট ও খারাপ আচরণের অভিযোগে প্রথম স্ত্রী তাকে দেড় বছরের মাথায় তালাক দিয়েছিলেন। ২০১০ সালে লায়লা দেনমোহর ও ভরণপোষণের দাবিতে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। অনাধিক ৫০ হাজার টাকার একটি আংশিক ডিক্রি পান। এর বিরুদ্ধে লায়লা আপিল করেছিলেন। কিন্তু পরে হাল ছেড়ে দেন।
দ্বিতীয় স্ত্রী রুবিনা যৌতুক বিরোধী আইনের ৪ ধারায় ২০১৭ সালে মামলা করেন টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেটের কোর্টে। রুবিনা মাউশিকে বলেছেন, এরপর থেকে তার প্রতি তার স্বামীর ভয়-ভীতি প্রদর্শন বেড়ে যায়। চলে তাকে তুলে নেয়ার হুমকি। এই অবস্থায় ২০১৭ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর তালাক দেন রুবিনা। তার মুক্তিযোদ্ধা পিতা মেয়ের জীবনের এই বিপর্যয় সইতে না পেরে তালাকের দু’দিন বাদেই মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান।
দৃশ্যপট-৩:
রুবিনা নাগরপুর থানায় রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অপহরণের হুমকি প্রদানের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন ২০১৭ সালের ৩১শে অক্টোবর। রুবিনা মাউশিকে লিখেছিলেন, তিনি মনে করেন তার পিতার মৃত্যু এবং তার পরিবারে কোন পুরুষ সদস্য না থাকায় রাজ্জাক তার উপরে এতবেশী নিপীড়ন চালাতে পারছে। কিন্তু মাউশি নীরব থেকেছে। কখনও তদন্ত করার আগ্রহ দেখায়নি। রাজ্জাকের কবল থেকে বাঁচতে রুবিনা বিয়ে করেন ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এরপর তার সাবেক স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরাতে তিনি সচেষ্ট হন। রুবিনাকে তার বর্তমান স্ত্রী দাবি করা অব্যাহত রাখেন। স্ত্রী পরিচয়ে তার নিজের ফেসবুকে যুগল ছবি পোস্ট করেন।
দৃশ্যপট-৪
দুই নারী ক্রমাগতভাবে আইনি লড়াই চালান। তারা রায় পান। কিন্তু তাদের আইনি লড়াইয়ের কোনো প্রভাব রাজ্জাকের ওপর পড়ে না। কারণ মাউশি তার পাশে ‘খাম্বা’র মতো দাঁড়িয়ে থাকে। পাবনার পারিবারিক আদালতের বিচারক সুমন কুমার কর্মকারের চেম্বার। ২০১৭ সালের ১৬ই এপ্রিল। এদিন রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আংশিক ডিক্রির রায় পান প্রথম স্ত্রী লায়লা। আদালত ভরণ-পোষণ এবং দেনমোহর বাবদ সর্বমোট ৪৮ হাজার ৭০০ টাকা ৬০ দিনের মধ্যে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রাজ্জাকের প্রতি নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালে প্রথম স্ত্রীর মামলায় অংশ নিয়ে রাজ্জাক আদালতে বলেছিলেন, তার প্রথম স্ত্রী তার সঙ্গে সংসার করতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু তার স্ত্রী তার বোন-ভগ্নিপতির কথামতো তাকে তালাক দিয়েছেন। তিনি টিউশনি করে জমানো ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা তালাকের পর স্ত্রীকে দিয়েছেন। তাই তার সাবেক স্ত্রী তার কাছ থেকে আর কোনো অর্থ পাবেন না। প্রথম স্ত্রী লায়লার এই মামলা এখনো চলমান রয়েছে।
দৃশ্যপট-৫:
২০১৭ সালের ১৫ই নভেম্বর। প্রথম স্ত্রী লায়লার মামলায় হেরে যাওয়ার ৭ মাস না যেতেই রাজ্জাক দ্বিতীয় স্ত্রী রুবানার মামলায় প্রতিকূল আদেশ পান। কারণ এদিন তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হয়। টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতের বিচারক আমিনুল ইসলাম লিখেন, আসামি রাজ্জাকের বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইনে অভিযোগ গঠন করার মতো যথেষ্ট উপাদান আছে। তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হলো। আসামির জামিন বাতিল বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। এদিন রাজ্জাক আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।
দৃশ্যপট-৬:
২০১৭ সালের ২৬ ও ৩১শে অক্টোবর, এই দু’দিনে রাজ্জাক দ্বিতীয় স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিতে ফিল্মি কায়দায় হামলা চালান। পুলিশ তার রিপোর্টে বলেছে, রাজ্জাক তার মোবাইল থেকে এসএমএস দিয়ে রুবিনাকে তার ‘স্কুল থেকে বা যেখানে পাবে সেখানে থেকে তুলে নেয়ার হুমকি’ দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ১৪ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার এএসআই মো. মেহেদী হোসেন রাজ্জাকের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়, ‘রাজ্জাক তার স্ত্রীর দেয়া তালাক মানতে চাননি। প্রমাণিত হয় যে, রাজ্জাক তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর ০১৭১৫-৩৪৭৭৭৭ সহ আরো একাধিক সিম দ্বারা ফোন করে হুমকি দিয়েছেন। মোবাইলে এসএমএস’র মাধ্যমে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। রাজ্জাক ঢাকায় তার কলেজে সপ্তায় ৩/৪ দিন ক্লাস নেন। বাকি দিনগুলোতে তিনি নাগরপুরে আসেন। বাদিনীকে ভয় দেখান। হুমকি দেন। এ সময় তিনি একটা কৌশল অবলম্বন করতেন। নিয়মিতভাবে তার যে সিম তিনি কলেজে ব্যবহার করেন, সেটি তিনি টাঙ্গাইলে গিয়ে ব্যবহার করতেন না। অন্য একাধিক সিম ব্যবহার করে তিনি তার সাবেক স্ত্রীকে তুলে নেয়ার হুমকি লাগাতারভাবে দিতেন। এ কারণে রুবিনা মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন।’ রাজ্জাকের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত বলেও পুলিশি তদন্তের ফলাফলে জানানো হয়।
এই রিপোর্ট দাখিলের পরদিনই ১৫ই নভেম্বর ২০১৭ রুবিনা আদলতে আর্জি দেন যে, ‘আসামি জামিনে মুক্ত থাকলে যেকোনো অসতর্ক মুহূর্তে তার অপূরণীয় ক্ষতি ঘটাতে পারে এবং বাদীকে অপহরণ করে তাকে হত্যা করে লাশ গুম করতে পারে। তাই রাজ্জাকের আসামির জামিন বাতিল করে তাকে জেলহাজতে আটক রাখার আদেশ প্রার্থনা করেছিলেন রুবিনা। কিন্তু আজো তার জামিন বাতিল হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের এই ধরনের তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত রাজ্জাকের অফিস কলিগ ও ঢাকায় তার বসদের নজরে নেয়া হলেও তার বিরুদ্ধে নথি নড়তো না।
দৃশ্যপট-৭:
রুবিনা ও তার স্বামী উভয়ে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তারা উভয়ে অনেক সময় নাওয়াখাওয়া ভুলে একটি মাত্র লোকের কবল থেকে বাঁচাতে রীতিমতো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দু’জনেই সরকারি চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও আরেক জন শিক্ষা ক্যাডারের ‘সিক’ সদস্যের খপ্পর থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছি না। সবসময় ভয়ে থাকি, কখন কোথায় কি করে বসেন! রুবিনা কান্না জড়িত কণ্ঠে রাজ্জাকের রাহুগ্রাস থেকে তাদের প্রাণপণ চেষ্টার বিবরণ দেন।
আমাদের অনুসন্ধানে এটা পরিষ্কার যে, ২০১৮ সালের ২০শে জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে টাঙ্গাইল জেলার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই-এর পুলিশ পরিদর্শক মো. কাওছার উদ্দীন তিন পৃষ্ঠার যে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন, তারপরে দীর্ঘ ১০ মাসের বেশি সময় ধরে রাজ্জাকের স্বপদে বহাল থাকাই একটা বিরাট দুর্নীতির দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা ক্যাডারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। আমাদের অনুসন্ধানে এটাই ফুটে উঠেছে, সরকারি প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকা আরেকজন শিক্ষা ক্যাডার সদস্যের জামিন বাতিল কেন দরকার, সেটা আদালতে দাবি করেছিলেন। আদালত নির্দিষ্টভাবে জামিন বাতিল করার যুক্তিতেই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পিবিআই বলেছে, রাজ্জাকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
পিবি আই রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, রাজ্জাক টাঙ্গাইলের সংশ্লিষ্ট স্কুলের কমনরুমে গিয়ে শিক্ষিকাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘রুবিনা তো আমাকে আটকাতে পারলো না, কেউই আমাকে আটকাতে পারবে না। ওকে আমার কাছে ফিরে আসতেই হবে।’
স্কুলের শিক্ষিকারা স্বীকার করেছেন যে, রুবিনা সাবেক স্বামী রাজ্জাক ‘সময়ে অসময়ে মোবাইলে কল দিয়ে তাদের বিরক্ত করতেন।’ স্কুলটির হেড ম্যাডাম নিজেই পুলিশ ডেকেছেন। স্কুলের নৈশ প্রহরী মোহাম্মদ আলীকে রাজ্জাক ঘুষ দিয়েছেন। একদিনে মোবাইলে ১৩ বারও কথা বলেছেন তিনি। রুবিনাকে বলতে বলেছেন, ‘আমি একটা সাদা রঙের গাড়ি নিয়ে আরো চার-পাঁচজন লোক নিয়ে আসছি। আমি তুলে নেব।’
পিবিআই বলেছে, আমরা প্রমাণ পাই যে, ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর তার সাবেক স্ত্রীকে অপহরণের চেষ্টা হয়েছিল। র্যাব’র গাজীপুরের পোড়াবাড়ী ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর মইনুল জানান যে, ওইদিন দুপুর দেড়টায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে থেকে একজন মহিলাকে অপহরণের কেউ চেষ্টা করছে মর্মে মোবাইলে ফোন আসে। আমরা তাৎক্ষণিক সেখানে গিয়ে রাজ্জাককে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসি। পরে ফোন করে রুবিনা ও তার মা’কে ডেকে নেন। সব প্রকাশ পেলে রাজ্জাক তার ‘কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত বলে জানান। সে কারণে র্যাব’র টিম তাকে সেদিন কোন মুচলেকা ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছিল বলে পিবিআই তার প্রতিবদেনে বলেছে।
দৃশ্যপট-৮:
আবদুর রাজ্জাক তার অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ডের নানা সাক্ষ্যপ্রমাণ রেখেছেন, যা অনুসন্ধানে আমাদের হাতে এসেছে। বয়স ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মেধাবী রাজ্জাক দুই স্ত্রীর দ্বারা তালাক প্রাপ্ত হয়েছেন।
২০১৭ সালে ঢাকার পারিবারিক আদালতে তিনি ‘দাম্পত্য পুনরুদ্ধারের’ একটি মামলা করেন। এতে তিনি দাবি করেন যে, স্ত্রীর ইচ্ছা থাকলেও তার মা বোনের কুপরামর্শে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে কখনও সহবাসের সুযোগ পাননি। ১৩ লাখ টাকার দেনমোহর আত্মসাতের উদ্দেশ্যে হুমকি দিয়ে লিখে নিয়েছে। এই মামলার আসামি রুবিনা, তার মা ও ছোট বোন। এই মামলার পাল্টা হিসেবে ঢাকার পারিবারিক আদালতে দায়ের করা রুবিনার আর্জিতে বলা হয়েছে, ওই ১৩ লাখ টাকার মধ্যে কাবিননামায় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা উসুল দেখানো হলেও আসলে তা ভুয়া। তিনি ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকার অনুকূলে ডিক্রি চান। উভয় মামলা চলমান রয়েছে।
দৃশ্যপট-৯:
আবদুর রাজ্জাক বরখাস্ত হওয়ার পরে যথারীতি ধরাধরি ও তদবিরে মেতেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, বুড়িগঙ্গা থেকে এতটা পানি গড়ানোর পরে মাউশি এটা কী করল? এখন কি মাউশি রাজ্জাকের অপসারণ ও তাকে বিচাররের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে? বিশেষ করে তার সাবেক দুই স্ত্রীর দেনমোহরের টাকা আদায়ে মাউশির কি কিছু করণীয় আছে? নাকি কিছুদিন বিরতির পরে তার বরখাস্ত আদেশ উবে যাবে এবং তাকে বহাল তবিয়তে চাকরিতে রাখা হবে?
ওই তিন নারীর বিচার চাওয়ার বাণী কি নিরবে-নিভৃতে কাঁদবে?