নারীর সামাজিক মর্যাদা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

নারী জন্মদাত্রী মা, নারী পুরুষের সকল প্রেরণার উৎস, নারী দুর্দমনীয় ‘হিম্মত’ এর অধিকারিনী। এ সবই তো সত্য। তার চেয়েও বড় সত্যটি বড়ই কদাকার। বিষয়টি আর পাঁচ-দশজনের মতো আমাকেও পীড়া দেয়, ব্যথিত করে। আর সেটা হলো- যুগে যুগে, দেশে দেশে নারী লাঞ্ছিতা, বঞ্চিতা, নারী কর্মক্ষেত্রে দারুণ বৈষম্যের শিকার। কিন্তু কেন? এর প্রতিকারই বা কী? এই ‘কেন’র উত্তর পাওয়া গেলেও আজ অবধি ‘কী’-এর  উত্তর মিলছে না। সমস্যার যতই গভীরে যাই, দেখি- অনেক কিছুই বুঝি না, যা বুঝি তা হলো নারী বৈষম্যের জটিল অঙ্কগুলো খুবই ছোট ছোট, অথচ প্রত্যেকটি সমীকরণ মানব ইতিহাসের মতোই বিস্তৃত।

নারী জীবনের এ দুর্বোধ্য বিড়ম্বনাগুলো আমাকে যখন তখন তাড়া করে। কারণ, আমি তো নারীরই পেট থেকে বেরিয়ে আসা একজন নর, আমিও যে নারীর স্বামী, নারীর পিতা, নারীর ভাই, নারীর আরও কত কিছু। নারী জীবনের টানাপোড়েন আমি খুব কাছে থেকে হর-হামেশাই দেখি, গভীরভাবে অনুভব করি, অনেক সময় কষ্টও পাই, এ সবের মাঝেই আমার বসবাস।
 
নারীর সাথে নরের সম্পর্ক বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যে ভরা। ব্যক্তি নারী সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা থাকতেই পারে, তথাপি নারী জাতি এক ও অভিন্ন। নারীর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার টান যেমন তীব্র, তেমনি তার আবেগ-আবদারও কম নয় এবং তা উপেক্ষা করার মতো-তো নয়-ই। তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস যেমন উত্তাল সাগরে ঢেউয়ের মতন খেলে, তার মান-অভিমান ও মনের মতিগতিও তেমনি চঞ্চল ঝড়ো হাওয়ার মতো নিরন্তর বয়ে চলে।

যেসব আদম সন্তান নারীর রূপমাধুর্যের একাধিক মাত্রা স্পর্শ করে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করে, উপভোগ করে, তারা সুখী কিনা জানি না, তবে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। স্ত্রীকে পেতে হলে স্বামীকে নাকি স্বামী হওয়ার আগে ‘পুরুষ’ হতে হয় ! রবি ঠাকুরের লেখায় এমন আভাস পাওয়া যায়। এক সময় নারীরা স্বামীকে দেবতা হিসেবে মেনে নিতো অথবা নিতে বাধ্য হতো, আজ তারা স্বামীকে কেবল স্বামী হিসেবেই দেখে না, তাকে বন্ধু হিসেবেও পেতে চায়। নারীর এ আকাঙ্ক্ষা যথার্থ এবং যৌক্তিক। বুঝতে পারি, দিনে দিনে, দিকে দিকে এ ধারণার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এখানে সমাজ পরিবর্তনশীল ও অগ্রসরমান। 

অন্যদিকে এই আধুনিক সমাজের একটি অন্ধকার দিকও আছে। এই নারী কেন তার যথার্থ মর্যাদা পায় না, সে কেন অবহেলিত, সে কেন বার বার অপমানিত? তার দৈহিক শক্তি হয়ত কম হতে পারে, তার মনের জোর তো কম নয়। পুরুষের যেমন ছেলেমেয়ে আছে, মা-বাবা-আত্মীয় পরিজন আছে, নারীরও তো তাই। পুরুষের হাতে যত ক্ষমতাই থাকুক, দিনের শেষে সে-তো নারী-প্রেমের শক্ত বাঁধনে বাঁধা; নারীর কাছে সে ভালোবাসার কাঙাল নয় কি? এ জন্যই বলা হয়ে থাকে, ‘রাজা শাসিছে রাজ্য, রাজারে শাসিছে রানি’।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? নারীকে তার পূর্ণ মানবিক মর্যাদা ও বিষয়-সম্পত্তিতে ন্যায্য হিস্যা দিতে সমাজের এত অনীহা কেন? এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, তাবৎ দুনিয়ায় কমবেশি সর্বত্র একই হাল। নারীর প্রতি কেন এই অবিচার? দুঃখিত, এর জবাব আমার কাছে নেই। উত্তরবিহীন এই প্রশ্নটিকে পাঠকের দিকে ছুঁড়ে দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো গতি নেই। ‘সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজে নারীর মর্যাদার জায়গাটুকু তৈরি করে নিতে হবে’। কথাটি ষোলআনা সঠিক। তথাপি আমার একটি প্রশ্ন, এত নারীবাদী সংগঠন ও কর্মতৎপরতা থাকতে এতদিনে কেন কোথাও উল্লেখযোগ্য কোনো ফলাফল দেখা যাচ্ছে না?

আমার মায়ের মাতৃত্বই তাঁকে করে গেছে বলীয়ান, মহীয়ান, বিশালভাবে ‘ক্ষমতায়িত’। মায়ের উৎপাদিত পুঁজি আজ দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। তাঁর সন্তানেরা যে যেখানে গেছে সেখানেই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অবদান রাখছে। তাঁর উৎপাদিত পণ্যের মুনাফা তিনি তেমন একটা ভোগ করতে না পারলেও অন্যেরা তো করছে! এখানে তিনি যেমন ‘ক্ষমতায়িত’, তেমনি ‘মহান’। আমার মায়ের মতন জগতের সকল মা আপনা থেকেই ‘ক্ষমতায়িত’। নারী জাতির জন্য মাতৃত্বজাত ‘ক্ষমতা’, চাকরিকালীন  ক্ষমতা থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। সমাজ ও অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব ও ফলাফল অনেক বেশি টেকসই এবং সুদূর প্রসারি! 

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কে ঘরে থেকে ঘরের কাজ করবে আর কে বাইরে গিয়ে বাইরের কাজ করবে, এই ফ্যাসাদ করতে করতে নারী যদি মাতৃত্বকে পরিহার করে, মাতৃত্বকে অবহেলা করে তা হলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কী হবে! একবার ভেবে দেখুন- জাপান, রাশিয়া, স্ক্যান্ডিনিভিয়া ও অন্যান্য পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর কী হাল। সব সময় কাগজে বের হয়, সেসব দেশে মানুষের অভাবে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দোকানপাটে লালবাতি জ্বলছে, পোস্ট অফিসে পর্যাপ্ত লোক আসে না, রেলস্টেশনে যাত্রী নেই ইত্যাদি। তাহলে দেখা যায়, যেখানে মানুষ আছে সেখানেই কর্মতৎপরতা, সেখানেই সমৃদ্ধি, সেখানেই প্রাচুর্য, সেখানেই ‘ক্ষমতা’। আর বলাই বাহুল্য, মানুষের উৎস নারীর জঠর। এবার ভেবে দেখুন, নারীর ‘ক্ষমতায়ন’ - চাকরিতে, নাকি মাতৃত্বে।

রাজপ্রাসাদ হোক আর কুঁড়েঘর হোক, মায়ের অন্ধকার গর্ভ থেকে বেরিয়েই সন্তান ঘরকে আলোকিত করে। কারণ, সে শুধু একটি মুখ ও পেট নিয়ে জন্মায় না, সঙ্গে করে একটি মাথা ও দু’টি হাতও নিয়ে আসে। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে উৎপাদন করে আদমসন্তান- যাঁরা আগামী দিনের নাগরিক, আগামী দিনের শ্রমিক, আগামী দিনের সাংবাদিক, আগামী দিনের বিচারক, আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী।

মাতৃত্বের মর্যাদাকে আমি অনেক বড় করে দেখি। তথাপি, আমি নেপোলিওন বোনাপার্টের বিরোধিতা করি, যখন তিনি বলেছেন, ‘নারী কেবলই সন্তান উৎপাদনের একটি যন্ত্র’। আমার মতে কথাটি এভাবে বলা নারীর জন্য অসম্মানের। নারী যন্ত্র তো নয়-ই, সে কেবল ‘নারী’ও নয়; সে তার চেয়ে বড়, তার চেয়ে মহৎ, তাঁরা মায়ের জাত। সে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মা, মহীয়সী মা। আপনাদের সবার মতন আমিও চাই, নারী তার  সম্ভ্রম ও আব্রু বাঁচিয়ে আপন মর্যাদায় ও মহিমায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিরাপদে সফলতার সঙ্গে বিচরণ করুক, তবে মাতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে নয়। যে জাতি এটি করবে, সে অদূরে না হলেও সুদূর ভবিষ্যতে যে দুনিয়া থেকে অবলুপ্ত হবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলাই যায়।

লেখক : পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029010772705078