নিউইয়র্কে অজানা রোগে মারা যাচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীরা

মোকলেচুর রহমান মোল্লা, নিউইয়র্ক প্রতিনিধি |

নিউইয়র্ক শহরে করোনা আক্রান্ত হয়ে বা করোনার লক্ষণ নিয়ে শিশু ও কিশোর কিশোরীদের মারা যাওয়ার খবর না থাকলেও গত দুই সপ্তাহে ৫ জন স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে অজ্ঞাত রোগ আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। আরও ১১৯ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।

মারা যাওয়াদের মধ্যে ২ জন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাকিরাও ১৩ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সকলের বয়স ২১ বছরের নিচে।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা নিউইয়র্ক শহর বিশ্বের যেকোন শহরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল দেখে সার্বিক দিক খেতে থমকে গেছে। এর মধ্যে এপ্রিলের শেষের দিকে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য হারে উন্নতি হলেও নিউইয়র্কবাসীর আতঙ্ক যেন কিছুতেই পিছু হটছে না। হঠাৎ করেই এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে দুই তিন জন স্কুল বয়সী শিশু অসুস্থ হয়ে নিউইয়র্ক এর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু তাদের অসুস্থতার লক্ষণগুলো হাসপাতালের ডাক্তারদের কাছে একেবারেই নতুন ও খুবই ভীতিকর মনে হয়। নতুন ধরনের এই রোগের অনুসন্ধান করতে ও আক্রান্ত শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে নিউইয়র্ক স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আবারো এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। কোন কিছু বুঝে ওঠা বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মধ্যেই একেক করে বহু শিশু একই রোগের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকে।

আক্রান্ত শিশুদের বেশির ভাগই কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত উচ্চমাত্রার মাত্রার জ্বরে ভোগে তার সাথে পেটে ব্যথা ও শারীরিক অস্থিরতা প্রবলভাবে দেখা যায়।  তাদের ডায়রিয়া ও বমি হয়। গায়ে রোদি ও র‌্যাস হয়। চোখ খুব লাল বা গোলাপী হয়ে যায়। গলার এক পাশের গ্রন্থি টনসিলের মতো ফুলে ওঠে। ঠোট ফেটে লাল ও রক্তমুখী হয়ে যায়। জিহ্বা গোলাপের মতো লাল হয়ে যায়। হাত ও পা ফুলে লাল হয়ে যায়। এই ধরনের লক্ষণ সাধারণত ‘কাওয়াসাকি’ (Kawasaki) রোগী ও টকসিক শক (toxic shock) রোগীদের মধ্যে দেখা যায়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ ফুলে যায়। শরীরে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই রোগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও চিকিৎসায় সিটি কতৃপক্ষ যেন কোনো অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরার মতো পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে।

করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এই লক্ষণগুলোর অনেকটাই দেখা না গেলেও অনেক চিকিৎসকরাই একে করোনা আক্রান্ত পরবর্তী কোনো জটিলতা বলে মনে করছেন। তবে এ বিষয়ে এখনো চিকিৎসকই নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছেন না। করোনার সাথে এর সংশ্লিষ্টতা থাকার ধারণার কারণ হলো, গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই নতুন লক্ষণ নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের অধিকাংশই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে আর যারা করোনা হয় নাই তাদের শরীরে করোনার এন্টিবডি বা করোনা প্রতিরোধক পাওয়া গেছে। আর চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী কেউ করোনায় আক্রান্ত না হলে তার শরীরে করোনার এন্টিবডি বা করোনা প্রতিরোধক থাকার কথা না।

নিউইয়কের্র গভর্নর এন্ড্রিউ এম কুমো (Andrew M. Cuomo) বলেন, স্টেটের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১০২ জনের মধ্যে ৬০ শতাংশ কোভিড-১৯ পজিটিভ; ৪০ শতাংশের শরীরে করোনা ভাইরাসে এন্টিবডি রয়েছে। আবার ১৪ শতাংশের শরীরে করোনা ভাইরাস ও এন্টিবডি দুইটাই পাওয়া গেছে।

নিউইর্য়ক স্বাস্থ্য বিভাগ এই রহস্যজনক রোগের নামকরণ করেছে পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লোমেটরি সিনোড্রম (Pediatric Multi-System Inflammatory Syndrome-PMI) এই রোগ বিরল হলেও এটা যে এক ব্যক্তি থেকে আর এক ব্যক্তির শরীরে ছড়ায় না তা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবুও যেহেতু এটি একটি মরণঘাতী রোগ। তাই এই এর লক্ষণ সম্পর্কে জানা ও সচেতন হওয়া বিষয়ে ভীষণ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

নিউইয়র্ক স্টেট হেলথ ডিপার্টমেন্ট ও সেন্টার ফর ডিসেজ কন্ট্রোল দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ও হাসপাতাল ব্যবস্থা ও অন্যান্য এস্টেট সমূহকে এই রোগ চিহ্নিত করা, তদারকি করা ও এ সম্পর্কে করণীয় বিষয়ে নীতিমালা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এক বিবৃতিতে সিডিসি জানায়, যে, ‘পিএমআইএস’ কে তদারকির আওতায় রাখতে, আরও ভালোভাবে লক্ষণ বুঝতে ও এর একটা সংজ্ঞা তৈরি করতে তারা কাউন্সিল আব স্টেট (Council of Stat), টেরিটরিয়াল ইপিডেমিওলজিস্ট (Territorial Epidemiologists) ও দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ করছে।

বিখ্যাত চিকিৎসক এন্থনি এস ফাউসি (Anthinny S. Fauci) গত সপ্তাহে ইউএ সিনেটের কাছে শিশুদের অদ্ভূত এই শরীর ফুলে যাওয়ার লক্ষণ করোনার নতুন কোনো ভাইরাসের কারণে হচ্ছে বলে প্রকাশ করেন। এছাড়াও, আগামী ফল (Fall) এ, অর্থাৎ (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) এ স্কুল খুলতে পারার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন। এখন নিউইয়র্কে বাইরের বিভিন্ন শহরেও বেশ কিছু শিশু একই লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়, নিউজার্সি, কেলিফোর্নিয়া, লুইজিয়ানা ও মিসিসিপিসহ আরও কিছু স্টেটে বেশ কিছু রোগী পাওয়া গেছে।

নিউইর্য়ক সিটির শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে নিউইর্য়ক শিক্ষা বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নিউইর্য়ক শিক্ষা বিভাগের চ্যান্সেলর রিচার্ড এ কারাঞ্জা (Richard A. Carranza) শিক্ষর্থীদের অভিবাবকদের এক চিঠির মাধ্যমে এই বিরল রোগ সম্পর্কে অবহিত ও সতর্ক করে দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি যদি কারো বাচ্চা অসুস্থ হয় ও টানা জ্বর থাকে এবং এই সকল লক্ষণসমূহ দেখা যায়, তবে তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার জন্য বলেছেন। আবার যদি কোনো বাচ্চা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটবর্তী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতে বা ৯১১ এ কল করতে বলেছেন। 

উল্লেখ্য, ৯১১ এ যে কোনো সময় যে কেউ অসুস্থ কল করলে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানার পুলিশ অ্যাম্বুলেন্সসহ এসে রোগী দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038540363311768