নিরক্ষর নারীরা পড়ছেন অ আ ক খ

বরিশাল প্রতিনিধি |

বরিশালের স্টেডিয়াম বস্তিতে (বঙ্গবন্ধু কলোনি) শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত নারী ও শিশুদের অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একদল উদ্যমী শিক্ষার্থীরা। ‘স্বপ্ন দেখি-স্বপ্ন দেখাই’ স্লোগান নিয়ে গত ২৬ মার্চ থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উচ্ছ্বাসের ‘স্বপ্ন পূরণ’ বিদ্যানিকেতনের যাত্রা শুরু। বর্তমানে তাদের কাছে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার বিকেলে ক্লাস করছেন অর্ধ শতাধিক নিরক্ষর নারী এবং শতাধিক শিশু। ছোট বেলায় নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অক্ষরজ্ঞান নিতে না পারলেও পড়ন্ত বেলায় এসে নিজের নাম লেখাসহ ‘অ আ, ক খ, ১ ২ ৩’ শিখতে পেরে গর্বিত সুবিধাবঞ্চিত নারীরা। আর শিশুরা স্বপ্ন দেখছে বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার।

নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ যখন ফেসবুক আর ইন্টারনেটে আসক্ত, ঠিক সেই সময়ে নীরবে নিভৃতে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে এ সংগঠনটি। আর শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বরিশালের উদ্যমী শিক্ষার্থীরা সারাদেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর।

নগরীর চাঁদমারী মাদরাসা রোডে খোলা আকাশের নীচে পলিথিন আর চটের ওপর বসে একপাশে আদর্শ লিপি শিখছেন স্টেডিয়াম বস্তির বাসিন্দা রিকশা চালক আজিবর রহমানের স্ত্রী ত্রিশোর্ধ হালিমা আক্তার ইতি। অপরপাশে আদর্শলিপি শিখছেন তার ৫ বছর বয়সের ছেলে আব্দুল কাদির আল আরাফ। ছোট বেলায় লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও মধ্য বয়সে লেখাপড়া শিখতে পেরে আনন্দিত ইতি। ক্লাসের পড়া বাসায় গিয়ে ছেলের সাথে পুনরাবৃত্তি করেন তিনি। এতে তিনি এবং তার ছেলে দু’জনই উপকৃত হচ্ছেন বলে জানান ইতি। ইতির মতো ওই বস্তির অর্ধ শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত নারী প্রতি সপ্তাহের দুইদিন ক্লাস করছেন। নিজের নাম লেখাসহ শিখছেন আদর্শ লিপি, নামতাসহ হিসাব।

ওই স্কুলের শিক্ষার্থী পঞ্চাশোর্ধ আকলিমা বেগম বলেন, ছোট বেলায় পড়ালেখার সুযোগ পাইনি। নিজের নামটাও লিখতে পারতাম না। এই স্কুলে এসে অ আ, ক খ এবং ১ ২ ৩ লেখা ও হিসেব শিখেছি। এই শিক্ষা তিনি তার বাসায় সন্তানদেরও শেখাতে পারবেন বলে জানান। গৃহস্থালি কাজ কর্ম ফেলে এবং সময় নষ্ট করে এই স্কুলে এসে কিছু শিখতে পেরে লাভবানই হচ্ছেন বলে জানান তিনি। ষাটোর্ধ শিক্ষার্থী জরিনা বেগম জানান, আগে লেখা পড়ার সুযোগ পাইনি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের স্কুলে এসে কিছু শিখতে পেরে আনন্দে তার মনটা ভরে যাচ্ছে। পঞ্চাশোর্ধ জোৎস্না বেগম বলেন, এই স্কুলে পড়ানোর জন্য আগে তাদের সন্তানদের নাম নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তখন তিনিও লেখাপড়া শেখার আবদার করেন তাদের কাছে। স্যারেরা খুশি হয়ে তাদেরও পড়াতে শুরু করেন। এখন তিনি অনেক কিছুই লিখতে এবং পড়তে পারেন।

ওই বস্তির ৬৫ বছর বয়স্ক ফিরোজা বেগম বলেন, ছোট বেলায় বড় ওয়ানে পড়ার সময় তার বাবা মারা যায়। এরপর আর পড়াশোনার সুযোগ পাননি। এই স্কুলে এসে অ, আ, নামতা শিখে অনেক উপকার হচ্ছে তার। এই স্কুলে আসতে লজ্জা শরমের কোনো বিষয় নেই বরং শিখতে ভলো লাগে। বয়স্ক নারীদের পাশেই পলিথিনের উপর বসে পড়াশোনা করছে শতাধিক শিশু। তাদের একজন ইয়াসিন আরাফাত জানায়, এই স্কুলে লেখাপড়া, আদব-কায়দা এবং ভালো কাজ করতে শেখানো হয়। বড় হয়ে সে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। শিশু সুমাইয়া বলে, এই স্কুলে এসে লেখাপড়ায় অনেক উন্নতি তার। শুধু লেখাপড়াই নয়, মানুষের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে, গুরুজনের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সবই শেখানো হয় এই স্কুলে। ঘোরাফেরা খেলাধুলা বাদ দিয়ে এই স্কুলে এসে লাভ নাকি ক্ষতি হলো জানতে চাইলে শিশু সুমাইয়ার উত্তর- তাহলে তো কিছু শিখতে পারতেন না, বড় হতে পারতেন না। এখন লেখাপড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন তার।

‘স্বপ্ন পূরণ’ স্কুলে পড়ানো হয় নারী ও শিশুদের। কিন্তু নিরক্ষর পুরুষদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে। তাই স্থানীয় প্রবীন বাসিন্দা সত্তর ছুঁই ছুঁই আব্দুল মজিদ হাওলাদার সপ্তাহের দুইদিন এসে বসে থাকেন স্কুলের পাশে। অন্যান্যদের দেয়া শিক্ষা দূর থেকে আয়ত্বে নেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। তিনি বলেন, এই স্কুল থেকে নাম দস্তখত এবং অফিস আদালতের কাজ সারতে পারেন মোটামুটি। তিনি এই স্কুলের উদ্যোক্তাদের মনভরে দোয়া করেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028250217437744