ইউরোপের অনেক দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম বিধায় কাজ করার লোকের সংকট এবং বার্ধক্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। ইতালি সরকার সম্প্রতি তৃতীয় সন্তান গ্রহণ করা দম্পতিদের জন্য এক খণ্ড জমি বরাদ্দের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। ইউরোপের অনেক দেশে শূন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির দেশ রয়েছে। কাজের জন্য তারা রোবটের আশ্রয় গ্রহণ করতে যাচ্ছে। প্রচণ্ড জনসংখ্যার চাপ মোকাবেলা করার জন্য চীন তাদের একসময়ের এক সন্তান নীতি থেকে সরে এসেছে। এক সন্তান নীতির ফলে বর্তমানে তাদের বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং বার্ধক্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের দেশে এ সমস্যা এখনো প্রকট আকার ধারণ না করলেও অদূর ভবিষ্যতে আমরাও বার্ধক্য সমস্যায় পড়ে যাব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমবে এমন আশা থেকে এবং চিকিৎসাসেবার সাফল্য বার্ধক্য সমস্যাকে এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আমাদের রয়েছে বিশাল কর্মক্ষম মানুষ, যাদের মধ্যে তরুণসমাজের সংখ্যা আরো বেশি। এরা কাজ করতে সক্ষম, কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে তারা বেকার। এদের মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা পর্যাপ্ত। জনসংখ্যা কাঠামো অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে একটু ভিন্ন হলেও অনেক দেশ কর্মসংস্থানে এগিয়ে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কোনো না কোনো কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। ফলে বার্ধক্য সমস্যা প্রকট হলেও কর্মসংস্থানের অভাব হয় না। বয়স্কদের বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রেখে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
একটি দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ও তাদের জন্য সেই পরিমাণে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বেকার সমস্যা থাকার কথা নয়। বাংলাদেশের জনমিতিক তথ্য মতে, বর্তমানে ১৪ থেকে ৬৪ বছরের মানুষের সংখ্যা ৬৪ শতাংশ। যাদের মধ্যে বড় সংখ্যক তরুণ। তারা সবাই কমবেশি কাজ করতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেকার বা প্রচ্ছন্ন বেকার। নির্দিষ্ট ও মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মধ্যে শিক্ষিত বেকার রয়েছে, যাদের বড় একটি অংশ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। তারা পারছে না সাধারণ স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মতো শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে। আবার অফিশিয়াল কাজের সুযোগ সীমিত এবং দুষ্প্রাপ্য। ফলে তারা কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বেকার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদের জন্য কোনো কোনো বিষয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্র্যাজুয়েট আমরা তৈরি করছি, আবার কোথাও প্রয়োজনের কম গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে। ফলে চাকরির ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলাফল দেশে অনেক বেকার জনবল আর প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে লোক এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
যন্ত্রকৌশলে পারদর্শী একজন লোক যন্ত্র তৈরি করতে পারবে। আমাদের প্রয়োজন এমন যন্ত্রকৌশলে পারদর্শী জনবল। স্বাধীনতার অনেক বছর অতিক্রম করার পরও আমরা গাড়ি তৈরিতে সক্ষম হইনি। এখনো বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করতে হয়। ইলেকট্রনিক কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সফলতা আছে, কিন্তু সেই পরিমাণে নেই। ফলে এখনো বিদেশনির্ভরতার কারণে আমরা দুই দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। আর পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। আরো বড় ক্ষতি হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের যে পরিমাণ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, সেই পরিমাণ যেতে পারিনি। মেধাবীদের একটি বড় অংশ দেশে পর্যাপ্ত, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ন্যূনতম সুযোগ না পাওয়ার কারণে উচ্চশিক্ষা ও চাকরি নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। জাপান কিংবা চীনের জন্য এটি বড় সমস্যা নয়, কেননা তারা প্রযুক্তিবিদ্যায় অনেক এগিয়ে। কিন্তু আমাদের জন্য সমস্যা বটে। আমাদের মেধাবীদের ধরে রাখতে হলে অবশ্যই তাদের উপযোগী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। না হলে দেশ প্রযুক্তিবিদ্যায় সামনের দিকে এগোবে না।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে আমরা শিক্ষায় যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারছি না। মোটা দাগে এর বড় কারণ আমাদের যথাযথ পরিকল্পনার অভাব। অর্থাৎ শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক না থাকা এবং কর্মসংস্থানের পরিমাণে শিক্ষা বেশি থাকা। সবাইকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এমন কেন। সম্পর্কহীন শিক্ষা মানুষকে কোনো আশার আলো দেখাতে পারে না, যখন শিক্ষাকে কর্মসংস্থানের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। সম্প্রতি আমার সৌভাগ্য হয়েছিল চীন ও মালয়েশিয়া ভ্রমণের। সেখানকার ছেলে-মেয়েরা কোনো না কোনো কাজ করে। কাজের সুযোগের অভাব লক্ষ করা যায় না। গত দুই দশকে আমাদের দেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির দিকে যাচ্ছে সন্দেহ নেই। নতুন নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি আইটি সেক্টরের অনেক উন্নতি হয়েছে। এসব জায়গায় নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং আরো হবে, কিন্তু তার পরও বলতে দ্বিধা নেই যে আমাদের বেকার সমস্যা এখনো প্রকট।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবে। ইশতেহারে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আমাদের কাম্য। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ফোকাস হতে হবে দেশের শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত এবং নিরক্ষর মানুষের জন্য। আমরা বারবার বলে আসছি, শিক্ষা হতে হবে পরিমাণমাফিক। এতে করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সুনিশ্চিত হবে।
অপরিমাণভিত্তিক এবং অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা বেকারত্ব ও হতাশাকে বাড়িয়ে দেয়। তরুণের মধ্যে আশার আলো জাগাতে হলে শিক্ষানীতির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান নীতিও থাকা চাই। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই পারে এ সমস্যার সমাধান করতে। নির্বাচন সামনে এলে রাজনৈতিক দলগুলো তরুণসমাজের কথা বলে। তারা বলে, তরুণ ও নতুন ভোটার পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি। কিন্তু সেই তরুণদের ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা আমাদের জানা দরকার। আমাদের প্রত্যাশা, নির্বাচনী ইশতেহারে দল ও জোট শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেবে। আমরা চাই সবাই স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হবে, হবে শিক্ষিত এবং নিজ নিজ শিক্ষাকে ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি। শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানের মেলবন্ধন রচিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ