নীতিমালা ছাড়াই সিলেটে দুই শতাধিক মহিলা মাদরাসা

সিলেট প্রতিনিধি |

সিলেটে কোনো ধরনের নীতিমালা ছাড়াই গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক মহিলা মাদরাসা। খোদ সিলেট নগরীর বিভিন্ন পাড়ায় গড়ে ওঠেছে অসংখ্য আবাসিক ও অনাবাসিক মহিলা মাদরাসা। এসব মাদরাসার অধিকাংশই কওমি মাদরাসা বোর্ডগুলোরও নিয়ন্ত্রণে নেই।

 যদিও সংশ্লিষ্ট মহল মাদরাসাগুলোকে মহিলা মাদরাসা হিসেবে প্রচার করছেন। কিন্তু যারা পড়ালেখা করছে তারা শিশু ও তরুণ। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এতিম ও দরিদ্র পরিবারের। বিবাহিতদের এসব মহিলা মাদরাসায় ভর্তি করা হয় না বলে জানিয়েছেন মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা।
 
সিলেট বিভাগের কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় তাদের অধীনে ৭২৭টি মাদরাসা ও ৮৪টি মহিলা মাদরাসা রয়েছে।

কওমি মাদরাসার সবচেয়ে বড় শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’র ওয়েব সাইটে তাদের নিয়ন্ত্রণে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট বিভাগে মাদরাসার সংখ্যা (পুরুষ ও মহিলা) উল্লেখ করেছে এক হাজার ৬১টি।

এদিকে কওমি মাদরাসা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেট বিভাগে দুই হাজারের অধিক কওমি মাদরাসা রয়েছে। এর মধ্যে মহিলা মাদরাসা হবে প্রায় ৫ শতাধিক। এসব মহিলা মাদরাসা আলাদা কোনো নিয়ম-নীতি ছাড়াই চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ৩০ থেকে ৪০টি মহিলা মাদরাসা রয়েছে। অধিকাংশ মাদরাসাই নগরীর বিভিন্ন পাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। বাসার দু’-তিন রুম ভাড়া নিয়ে কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক এসব মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। 

শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেটের এমন কয়েকজন ব্যক্তি জানান, বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে শিশুরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর এই নির্যাতন কওমি মাদরাসাগুলোতেও হচ্ছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠান করতে অনেক নিয়ম নীতি মেনে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে করতে হয়। কিন্তু, মহিলা মাদরাসাগুলো যার যেমন ইচ্ছে প্রতিষ্ঠা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতনের হার দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও তাদের অভিমত। 

একজন অভিভাবক জানান, ধর্মীয় আবেগ থেকে তিনি তার মেয়েকে সিলেট নগরীর একটি মহিলা মাদরাসায় ভর্তি করে ছিলেন। কিন্তু কিছু দিন পর তিনি দেখলেন এ মাদরাসায় শিশুর পড়া লেখার পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ। তাই তিনি শিশুটিকে আর সেখানে দিচ্ছেন না। 

সিলেটের মহিলা মাদরাসাগুলোর জন্য আলাদা কোনো নিয়ম নীতি নেই বলেও জানালেন, আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বছির। তিনি বলেন, আগে মহিলা মাদরাসা তারা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করতেন না। কিন্তু বর্তমানে যুগের সাথে তাল মেলাতে এবং নারীদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় গত বছর থেকে তারা মহিলা মাদরাসাকে আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ পর্যন্ত ৮৪টি মহিলা মাদরাসা তাদের অধীনে এসেছে। তবে অনেক মাদরাসা এর বাইরে রয়ে গেছে।

মাওলানা আব্দুল বছির জানান, সাধারণ মাদরাসা বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে মাদরাসার জমির দলিল, কমিটি ও সদস্য সংখ্যা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংখ্যার কাগজ বোর্ড কর্তৃপক্ষ বরাবরে জমা দিয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য একটি আবেদন করতে হয়। এরপর সবকিছু যাচাই বাছাই করে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে মহিলা মাদরাসাগুলোর জন্য এসব নিয়ম ছাড়াও আরও কিছু নিয়ম রাখতে হবে। এ নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা চলছে। আমরা মহিলা মাদরাসাগুলোর জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়নের চিন্তা করছি। 

গতকাল সোমবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ধর্ষণের পর একজন ছেলে শিশুসহ মোট ১৬জন শিশু মারা গেছে। ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ৪০৮টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এই তথ্য পেয়েছে।

প্রতিবেদনের আরও বলা হয়, অন্তত ৪৯টি শিশু (৪৭ জন মেয়েশিশু ও ২ জন ছেলে শিশু) যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৩৫৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বলে জানিয়েছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে মারা গেছে ২২ জন এবং আহত হয়েছে ৩৩৪ জন। শিশু ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট জাকিয়া জালাল জানান, আমরা শিশুদের সুরক্ষা দিতে পারছি না। এখন আর বাসার আঙ্গিনা, স্কুল, মাদরাসা ও মক্তবে শিশুরা নিরাপদ নয়। 

তিনি বলেন, সম্প্রতি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার কেন্দুয়া পৌরশহরের একটি মহিলা কওমি মাদরাসার অধ্যক্ষ আবুল খায়ের বেলালী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেটা কত ভয়াবহ। ওই অধ্যক্ষ আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে দুই শিশুকে ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করেছেন। এর আগে মাদরাসার আরও ছয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন বলেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বেলালী।

সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ওই অধ্যক্ষ মাদরাসাটির একটি কক্ষে থাকতেন। আবাসিক হওয়ায় ওই মাদরাসাটিতে বেশ কয়েকজন এতিম-অসহায় শিক্ষার্থী থেকে লেখাপড়া করে আসছিল। তিনি বলেন, এসব মাদরাসায় যথাযথ তদারকি না থাকায় ও আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতার জন্য আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাই এই অপরাধ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। 

এ বছর জানুয়ারী মাসে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের জামেয়াতুল ইসলাম লিলবানাত খালপার টাইটেল মহিলা মাদরাসার সহকারী শিক্ষক হাফিজ কবির আহমদ (৪০) মাদরাসার তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু ছাত্রীকে মাদরাসার দ্বিতীয় তলার একটি নির্জন কক্ষে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। মেয়েটি শিক্ষকের কাছে যৌন হেনস্থার কথা পরিবারের কাছে গিয়ে বলায় মাদরাসায় আসা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে শিশুর পরিবার তাকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ওসিসি বিভাগে ভর্তি করেন। ডাক্তারী পরীক্ষায় শিশুটিকে যৌন হেনস্থার প্রমাণ পাওয়ার পর এ ঘটনায় কানাইঘাট থানায় অভিযুক্ত শিক্ষক কবির উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পুলিশ শিক্ষক কবির আহমদকে গ্রেফতার করে। 

এ বিষয়টি নিয়ে আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল বছির বলেন, আলেমদের দ্বারা এসব অপকর্ম মেনে নেয়ার মতো নয়। দু’একজনের জন্য পুরো আলেম সমাজ কলঙ্কিত হচ্ছেন।

কানাইঘাটের মহিলা মাদরাসাটি আমাদের বোর্ডের অধীনে নয়। শুনেছি, একজন ব্যক্তি এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে নিজের মতো করে পরিচালনা করছেন। মাওলানা আব্দুল বছির বলেন, নিরাপত্তার জন্য আবাসিক মহিলা মাদরাসা না করাই ভালো। ভারতের দেওবন্দ গিয়ে দেখেছি, সেখানে মহিলা মাদরাসা আবাসিক নয়। মেয়েদের গাড়িতে করে আনা হয় আবার ক্লাস শেষে পৌঁছে দেয়া হয়। এ ছাড়া মহিলা মাদরাসাগুলোতে সার্বক্ষণিক মহিলা শিক্ষক থাকতে হবে। মাদরাসা পরিচালনার জন্য একজন পুরুষ মুহতামিম থাকবেন। 

মদন মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, শিশু ধর্ষণ বাড়ার কারণ হচ্ছে আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের ফল। আইনের শাসন সহজ পথে না চলার কারণে ও কড়াকড়িভাবে প্রতিফলিত না হওয়ায় আমরা ভারসাম্যহীন সমাজের পথে যাচ্ছি। এসব অপকর্ম প্রতিরোধে মানুষকে উচ্চকণ্ঠ হতে হবে। নৈতিক শিক্ষার সাথে বিবেকবোধ জাগ্রত করে সম্মিলিতভাবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে হবে।

তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতনের শিকারের অন্যতম একটি কারণ হলো অযোগ্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা। প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা সৎ না অসৎ এটা এখন দেখা হয় না। অসৎরাই দাপটের সঙ্গে সব স্থান দখল করে আছে। 

তিনি আরও বলেন, মাদরাসা শিক্ষা বিশেষ করে কওমি মাদরাসার কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় ইচ্ছে মতো যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে এসব প্রতিষ্ঠান। ধর্মীয় বিষয় জড়িত থাকায় মানুষ এসবে নাক গলাতে চায় না। 

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান বলেন, আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। যার কারণে শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে শিশু সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে শিশু নির্যাতন বন্ধে সামাজিক সচেতনতা দরকার।

ব্লাস্ট সিলেটের কো অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট ইরফানুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে এখনো ‘ধর্ষণ’ সংজ্ঞায়িত করা হয় ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের দণ্ডবিধি অনুযায়ী। ধর্ষণের মামলা চলাকালীন বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে। জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের সন্নিবেশ ঘটাতে গিয়ে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।

অ্যাডভোকেট জাকিয়া জালাল বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু, এমন অনেক নজির আছে যে, বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। এক সময় বাদী-বিবাদী আপস মীমাংসা করে ফেলে। তাই মামলাকে শেষ পর্যন্ত আর নেয়া যায় না। এর ফলে অধিকাংশ ধর্ষণ মামলার ফলাফল ব্যর্থ হয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.010133981704712