মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার মূল পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ইমরান হোসেন মামুন ও ইফতেখার রানা। সোমবার (৬ মে) বিকালে তারা ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় এই জবানবন্দি দেন।
এ নিয়ে গ্রেফতার হওয়া ২২ জনের মধ্যে ১১ জন ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিল। জবানবন্দিতে তারা জানান, রাফি হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি খুনিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন তারা। ঘটনার সময় তারা মাদরাসার গেটে পাহারায় ছিলেন। মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই তারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন।
গত ২০ এপ্রিল মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ দু’জনকে গ্রেফতার করে। গত ২ মে তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নেয় তদন্ত সংস্থা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। সোমবার সকালে রাজধানীর মতিঝিলের এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ট্রেইনি অ্যাসিস্ট্যান্ট (ক্যাশ) অফিসার পদে যোগ দেন। তাকে ব্যাংকের সোনাগাজীর ডাকবাংলো শাখায় পদায়ন করা হয়েছে। গত ১৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাফির পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে গেলে নোমানের হাতে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে চাকরির নিয়োগপত্র তুলে দেয়া হয়।
রাফি হত্যার ঘটনায় দুই আসামির জবানবন্দির বিষয়ে পিবিআইর চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল জানান, ইফতেখার হোসেন রানা ও ইমরান হোসেন মামুন নুসরাত হত্যার মূল পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা বলেন, রাফিকে হত্যার পরিকল্পনায় ৪ এপ্রিল হাফেজ আবদুল কাদেরের কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় তারা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার দিন মাদরাসা ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও কিলিং মিশনে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের নিরাপদে বের হয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন বলে আদালতে স্বীকার করেন তারা।
এর আগে বিকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ইফতেখার হোসেন রানা ও ইমরান হোসেন মামুনকে আদালতে নিয়ে আসেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. শাহ আলম। বেলা ৩টা থেকে বিচারক তাদের জবানবন্দি রেকর্ড শুরু করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জবানবন্দি দেয়া শেষ হয়।
সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে তারা বলেন, ১ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার সঙ্গে দেখা করতে সহযোগী শাহাদাত হোসেন শামীম ও নুরুদ্দিনের সঙ্গে কারাগারে যান। তাদের সঙ্গে সিরাজের দুই ছেলে মিশু ও আদনানসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। সিরাজ সবাইকে কিছু একটা করার নির্দেশনা দেন।
কারাগারে দেখা করার পর ৩ এপ্রিল সন্ধ্যার পর মাদরাসার পশ্চিম হোস্টেলে কাদেরের কক্ষে একটি বৈঠক হয়। সেখানে অধ্যক্ষ মুক্তি পরিষদ গঠন করা হয়। যারা কারাগারে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তারা সবাই ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত সবাই সিরাজ উদ্দৌলকে মুক্ত করতে যে কোনো পদক্ষেপে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন।
পরদিন ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় একই স্থানে রাফিকে হত্যার বিষয়ে গোপন বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে শামীম, নুরুদ্দিন ও হাফেজ আবদুল কাদের হত্যার পরিকল্পনা উপস্থাপনা করে। ৬ এপ্রিল রাফিকে হত্যা করার মিশন বাস্তবায়ন করতে তারা সকালেই মাদরাসায় যান। রাফি হত্যার মিশনে অংশগ্রহণকারীদের তারা পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন। তখন তারা মাদরাসার গেটে পাহারায় ছিলেন। এ সময় তাদের দুজনের সঙ্গে আবদুল কাদের, নুরুদ্দিন এবং শরীফ ছিলেন।
ইমরান হোসেন মামুন সোনাগাজী পৌর এলাকার ৯নং ওয়ার্ডের চরগণেশ গ্রামের প্রবাসী এনামুল হকের ছেলে ও ইফতেখার উদ্দিন রানা সোনাগাজী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ঈমান আলী হাজীবাড়ির জামাল উদ্দিনের ছেলে। দুইজনই অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
প্রসঙ্গত, ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। কয়েকজন তাকে কৌশলে ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।
১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান অগ্নিদগ্ধ রাফি। এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ পর্যন্ত রাফি হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ২২ জনের মধ্যে সিরাজ উদ্দৌলাসহ ১১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সূত্র: যুগান্তর