নুসরাত হত্যা : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা ৭ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবে

ফেনী প্রতিনিধি |

ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের রায় (ডেথ রেফারেন্স) হাইকোর্টে আসার কথা রয়েছে।

এরপর আসামিদের মধ্যে যারা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে ইচ্ছুক তদের আপিল দায়েরের পর পেপারবুক তৈরি করে শুনানির প্রস্তুতি নেবেন আইনজীবীরা।

রায়ের শেষাংশে বলা হয়েছে, রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা চাইলে বা ইচ্ছা করলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল আবেদন করতে পারবেন।

রায়ে আরও বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারায় ‘মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের’ জন্য মহামান্য হাইকোর্টে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রায়ের অনুলিপি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেল সুপার ফেনী বরাবর পাঠানোর জন্য রায়ে বলা হয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ জজ মামুনুর রশিদ সব আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রায়ে সব আসামিকে পৃথকভাবে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে। নুসরাতকে হত্যার পর প্রায় সাত মাসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ হলো।

রায়ের পর নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এমনই হওয়া উচিত। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর স্বল্প সময়ে রায় হওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ রায় চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে হাইকোর্টে। কতজনের ফাঁসি থাকবে বা থাকবে না এটা হাইকোর্টের জন্য বিবেচ্য বিষয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তোষ প্রকাশ করছি এ জন্য যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে বিচারকাজটা সম্পন্ন হলো।’

দেশব্যাপী আলোচিত এ হত্যা মামলার রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ হাইকোর্টে আপিল করবেন আইনের বিধান অনুযায়ী। বিচারিক আদালতের রায়ের কপি হাইকোর্টে আসতে ফৌজদারি কার্যবিধির কয়েকটি ধারা অনুসরণ করা হবে।

ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এজন্য ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের) নথিপত্র হাইকোর্টে আসবে রায় ঘোষণার সাতদিনের মধ্যে। তামাদি আইনের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে সাতদিনের মধ্যে। এরপর যথযাথ নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য তৈরি করা হবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত)।

সাধারণত ডেথ রেফারেন্স শুনানি করা হয় বিভিন্ন উচ্চ আদালতের নিয়ম অনুযায়ী। তবে প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিলে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত করা হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে। ইতোপূর্বে বিভিন্ন মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানির ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি এ রকম নির্দেশ দিয়েছিলেন।

হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স শুনানি করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখতে বা কমাতে পারেন। আইন অনুযায়ী আসামিরাও সাজা থেকে খালাসের জন্য আপিল করতে পারবেন। তামাদি আইনের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে হয়। আপিল করলেই বিচারিক আদালতের সাজা স্থগিত হয়ে যাবে। এটি আইনের বিধান। ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করবেন হাইকোর্ট। এরপর এ মামলার কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করতে পারবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। এখানে আপিল আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। এরপরই চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে।

ফৌজদারি কার্যবিধির কতিপয় ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আপিলের বিধান করা হয়েছে। আপিল বিভাগে যাওয়ার আগে প্রয়োজন হতে পারে লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন)। লিভ টু আপিল গ্রহণ করা হলে আপিল করতে পারবেন সংক্ষুব্ধ আসামি বা বাদীপক্ষ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৪২ (ক) ধারা অনুযায়ী আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে। আপিল দায়েরের পর ৯০ দিনের মধ্যে সেটি নিষ্পত্তি করতে হয়। আপিলে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন আসামিরা। দণ্ডবিধির ৫৫ (ক) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আসামিকে ক্ষমা করে প্রাণভিক্ষাও দিতে পারেন।

ফেনীর আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার দুপক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছিলেন। আজ রায় ঘোষণা করা হয়।

এর আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করার মাধ্যমে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। নুসরাত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে তিনি যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেয়া হয়।

৬ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে ওই মাদরাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এ সময় তাকে পাশের বহুতল ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়।

১০ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাত মারা যান। এই ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (পিবিআই) স্থানান্তর করা হয়।

গত ২৯ মে আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। আজ অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামিরই ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064241886138916