নুসরাতকে হত্যার হুকুম ভুল ছিল, জবানবন্দিতে সিরাজ উদ দৌলা

ফেনী প্রতিনিধি |

ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এ জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। নুসরাতকে হত্যার কারণ হিসেবে সিরাজ বলেন, ‘সম্মিলিত স্বার্থের সামনে এসে যাওয়ায় নুসরাতকে হত্যার এই ছক করা হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার হুকুম দিয়ে ভুল করেছি। এভাবে হুকুম দেওয়া ঠিক হয়নি।’

জবানবন্দিতে সিরাজ উদ দৌলা আদালতকে বলেন, ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন তিনি। গত ১৯ বছর দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছে তার। সেই লোকদের নিয়ে মাদরাসার যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা বাস্তবায়ন করতেন তিনি। মাদরাসার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি কিছু ছাত্রের সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক তৈরি করেন। এদের মধ্যে ছিলেন মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, ছাত্রদলের সভাপতি নূর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের, জাবেদ, জুবায়ের, এমরান, রানা ও শরিফ। এদের বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়ে সহযোগিতা করতেন অধ্যক্ষ। পরীক্ষার ফি ও বেতন মওকুফ করে দেয়া হতো তাদের। এমনকি পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি ওদের পছন্দ অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীও ভর্তি করা হতো। এসব থেকে কমিশন নিতো তারা।

জবানবন্দিতে নুসরাতের ঘটনার প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে সিরাজ বলেছেন, ২৭ মার্চ সকালে পিয়ন নুরুল আমিনের মাধ্যমে নুসরাতকে মাদরাসায় তার কক্ষে ডেকে আনা হয়। খবর পেয়ে নুসরাতের সঙ্গে আরও তিন ছাত্রী কক্ষের সামনে আসে। সিরাজের কাছে তথ্য ছিল, নুসরাত অন্য ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সম্পর্ক ছিন্নের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে তাকে। ডেকে আনার পর শুধু নুসরাতকে কক্ষে ঢুকতে দেয়া হয়। অন্য তিন ছাত্রী কক্ষের বাইরে ছিলেন। ওই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সিরাজ বলেন, ‘কক্ষে কিছু কথা হওয়ার পর নুসরাত পড়ে যায়। এরপর আমি পেছন থেকে তার কোমরে দুই হাত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি তাকে। সে বসে থাকে। তারপর নুরুল আমিনকে ডাকি। পরে নুসরাত তার বান্ধবীদের সঙ্গে চলে যায়।’

এই ঘটনা নুসরাতের পরিবার জানার পর কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সেটা জানিয়ে জবানবন্দিতে সিরাজ জানান, ২৭ মার্চ দুপুরে নুসরাতের মা, ছোট ভাই, কমিশনার মাদরাসায় আসেন। এরপর সিরাজকে মারার চেষ্টা করেন নুসরাতের মা। একপর্যায়ে সিরাজও তাদের হুমকি দেন। সেখানে নূর উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। পরে শাহাদাত হোসেন শামীমও আসেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সোনাগাজীর আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোন করেন সিরাজ। রুহুল আমিন থানা থেকে এসআই ইকবালকে পাঠান। ইকবাল নুসরাতকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর সিরাজকে থানায় নিয়ে যান। সেখানে মামলা রেকর্ড করেন। সেই মামলায় গ্রেফতার হন তিনি।

হত্যা মিশনে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানিয়ে সিরাজ জবানবন্দিতে বলেন, শামীম ও নূর উদ্দিন তার খুব ঘনিষ্ঠ ছাত্র ছিল। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ হতো তার। মাদরাসার সিদ্ধান্ত নেয়া সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বললে তারা তা পালন করতো। পরীক্ষার সময় ছাত্রছাত্রী ভর্তি থেকে শুরু করে পরীক্ষা রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণসহ সব কাজের ভাগীদার হতো তারা। শুধু সরকারি ফি জমা করে বাকি টাকা তারা ভাগ করে নিতেন। এছাড়া কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় সিরাজের। তাদের মধ্যে কামরুন নাহার মনি (নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত) রয়েছেন। সিরাজের চেষ্টায় মনির বিয়ে হয়। এতে মনিকে সহযোগিতা করেন তিনি। তার বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে সিরাজের।

সিরাজ জবানবন্দিতে আরও জানান, ২৮ মার্চ তার অনুরোধে কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের তত্ত্বাবধানে মানববন্ধন করা হয়। শামীম, নূর উদ্দিন, কাদেরসহ অন্যরা মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে হাজির করেন। ওই দিন আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয় সিরাজকে।

২৯ মার্চ সিরাজের স্ত্রী ফেরদৌস আরা ও ছেলে আদনান প্রথম জেলখানায় দেখা করতে যান তার সঙ্গে। পরে সিরাজের স্ত্রী, শাশুড়ি, তিন বোন ও শ্যালক রাজু ও তার স্ত্রী তানিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কারাগারে যান। জেলখানায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি ‘ভক্ত গ্রুপ’ও দেখা করে সিরাজের সঙ্গে। তাদের মধ্যে শামীম, নূর উদ্দিন, জাবেদ, রানা ও আব্দুল কাদেরও ছিলেন।

জেলখানায় এই গ্রুপের সঙ্গে তার মামলা ও জামিন নিয়ে কথা হয়। আলাপ হয় নুসরাতের পরিবারকে আপস করতে বাধ্য করা ও মামলা প্রত্যাহারের জন্য তারা কী করছে তা নিয়ে। সিরাজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও মানববন্ধন চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন তিনি। এ সময় শামীম ও নূর উদ্দিনসহ কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া অন্যদের বকাবকি করেন সিরাজ। কিছু একটা চিন্তা করে দ্রুত তাকে জানাতে নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার কথাও জানান তিনি।

মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দির শেষে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা বলেন, ‘নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার হুকুম দিয়ে ভুল করেছি। এভাবে হুকুম দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি অনুতপ্ত। সত্য জবানবন্দি দিলাম।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005295991897583