শিক্ষা ও নৈতিকতা একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে। আর নৈতিকতা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তোলে। নৈতিকতার মূল উৎস ধর্ম। বাংলাদেশের প্রায় ১৫ কোটি মানুষ মুসলিম।
তাই ইসলামী নৈতিকতার ব্যাপক শিক্ষা ও চর্চাই এ দেশের মানুষকে বর্তমান নানামুখী অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পারে। সুতরাং এ দুটির সমন্বয় হলে একজন মানুষ সৎ, চরিত্রবান, আল্লাহভীরু, দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান সমাজের জন্য নৈতিক শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নৈতিকতা বলতে আমরা বুঝি নীতির অনুশীলন, নীতির চর্চা। কাজেই নৈতিকতা হল এমন এক বিধান যার আলোকে মানুষ তার বিবেকবোধ ও ন্যায়বোধ ধারণ ও প্রয়োগ করতে পারে। নৈতিকতা হল ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। আর এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও মর্যাদা।
সততা, সদাচার, সৌজন্যমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব, মিষ্টি কথা ও উন্নত চরিত্র- এ সবকিছুর সমন্বয় হল নৈতিকতা। একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চালচলন, ওঠাবসা, খাওয়া-দাওয়া, আচার-ব্যবহার, লেনদেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তি বলে।
নীতিহীন মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, যাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে দেখে না, কান আছে কিন্তু তা দিয়ে শোনে না। এরা হল চতুষ্পদ জন্তুর মতো। বরং তার চেয়েও পথভ্রষ্ট (সূরা আরাফ-১৭৯)।
অবক্ষয় শব্দের অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য, নিষ্ঠা, ধর্ম, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমত্ববোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণ লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়।
এটি হল সামাজিক মূল্যবোধের বিপরীত স্রোতধারা। নৈতিকতা ও আদর্শিক শিক্ষার অভাবই সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সামাজিক অবক্ষয়জনিত কারণে সৃষ্ট ও বিস্তৃত সামাজিক অপরাধ বেড়েছে বহু গুণ। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে।
নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে মানুষের হৃদয়বৃত্তিতে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। পরিণতিতে সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে বেড়ে চলছে আত্মহত্যা, হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা।
মা-বাবা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোয় ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস। আর এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমময় সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট।
ক্ষেত্রবিশেষ বলি হচ্ছে নাড়িছেঁড়া ধনসম্পত্তির মতো সন্তানসন্ততি। ফলে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুখ-শান্তি। যদিও পরিবারকে মানবজাতির প্রাথমিক শিক্ষালয় বলা হতো, কিন্তু সে অবস্থানে এখন আর পরিবারগুলো নেই।
মানুষের চাহিদাগুলোর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হল খাদ্য। প্রাণের ধারা বজায় রাখতে খাদ্য গ্রহণ অপরিহার্য। মানবদেহে শক্তি সঞ্চার করা, ক্ষয় পূরণ ও রোগ প্রতিরোধে খাদ্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে একটি বড় সমস্যা হল খাদ্যে ভেজাল।
আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যেই ভেজাল মেশানো হয়। বাদ যাচ্ছে না শাকসবজি, মাছ-মাংসও। যার ফলে ভেজাল খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ফলে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন জটিল ও মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে শাকসবজি, মাছ-মাংসও ভেজাল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ইউরিয়া, ফরমালিনসহ বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকেও বিষে পরিণত করা হচ্ছে! প্রশাসনের নজর এড়াতে ব্যবসায়ীরা বরফে ফরমালিন মিশিয়ে মাছের গায়ে ফরমালিন প্রয়োগ করে থাকে!
এসব শাকসবজি ও মাছ-মাংস খেয়ে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছে সাধারণ মানুষ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হোটেলে খাওয়ানো হচ্ছে মৃত মুরগি ও কুকুরের মাংস! বর্তমান বাজারে আম ছাড়াই উৎপাদিত হচ্ছে আমের জুস! কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কোনোরকম অনুমোদন ছাড়াই পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।
তা ছাড়া বর্তমানে ফলের বাজারগুলো আর ফলের বাজার নেই, বিষের বাজারে পরিণত হয়েছে দিনে দিনে! আম, আপেল, আঙুর, কলা ও মালটাসহ এমন কোনো ফল নেই যেটাতে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে না।
সাধারণ ফলমূলের চেয়ে কেমিক্যালযুক্ত ফলের রং হয় উজ্জ্বল, যার ফলে বেশি দামেও এসব ভেজাল পণ্য ক্রয় করে ঠকছে সাধারণ ক্রেতারা। ফলের রং উজ্জ্বল করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথাইলিন।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের ঘনঘন ঝটিকা অভিযান খাদ্যে ভেজাল অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে। অসাধু ব্যবসায়ী ও অপরাধে সংশ্লিষ্টদের মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ মানুষের ক্ষতি করে ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লাভের হীন মনমানসিকতা চিরতরে ত্যাগ করতে হবে।
সর্বোপরি, নৈতিকতার বিরামহীন চর্চা ও প্রশাসনিক সুনজর এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতার মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অবক্ষয়ী এ সমাজব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ যুবসমাজ। নৈতিকতাহীন শিক্ষায় তারা দূরে সরে যাচ্ছে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া থেকে। আর হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মাদকাসক্ত, ধর্ষক, ইভটিজার, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, সুদখোর ও ঘুষখোর।
এতে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার। স্যাটেলাইটের সুবাদে উন্মুক্ত অপসংস্কৃতির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত দেশীয় সংস্কৃতি। মোবাইলে ইন্টারনেট চালানো সহজ হওয়ায় যুবসমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুরাও ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার কল্যাণের নামে অকল্যাণ বয়ে আনছে।
কিছু পশুতুল্য এবং সম্পদশালী মানুষ মানবিক মূল্যবোদসম্পন্ন লোকদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এসব কুরুচিশীল মানুষ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে সমাজ। নিরীহ ভদ্রলোকরা সমাজে পদে পদে হচ্ছে কোণঠাসা ও নিগৃহীত। সমাজে দেখা যাচ্ছে ভয়াবহ অবক্ষয়। ধর্ষণ আজ মহামারীতে রূপ নিচ্ছে।
অফিস, কর্মস্থল, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বাসাবাড়িসহ সর্বত্র আজ নারী-শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষণ থেকে। ফলে জাতি আজ এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের কবলে পড়েছে। যারা উত্তম সমাজ নির্মাণের কারিগর তাদের নামও ধর্ষক তালিকায় আছে।
চরম লজ্জা ও দুর্ভাগ্যজনক হলেও লিখতে হচ্ছে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্কুলের শিক্ষক, প্রশাসক, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, থানার পুলিশসহ নানা পেশার নানা মানুষ এই কালো তালিকাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে।
সামাজিক মূল্যবোধের এ অবক্ষয় রোধে আমাদের অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে। নতুবা সম্মান বা মর্যাদা নিয়ে সমাজে বসবাস করা সম্ভব হবে না। তাই আশু করণীয় হিসেবে নিুবর্ণিত কর্মপন্থা বিবেচনা করা যেতে পারে-
১. নৈতিকতা বৃদ্ধিকল্পে ইসলাম ধর্মের জন্য ইসলাম, হিন্দুদের জন্য হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টানের জন্য খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধদের জন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ও নৈতিক শিক্ষার চর্চা করা। ২. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা ও উচ্চ নৈতিকমানের জন্য পুরস্কৃত করা। ৩. বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উন্মুক্ত অপসংস্কৃতি বন্ধ করা।
৪. শিশুদের হাতে মোবাইলে ইন্টারনেট প্রযুক্তি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় আইনি এবং সামাজিক ব্যবস্থা নেয়া। ৫. বিসিএসসহ সব নিয়োগ পরীক্ষায় গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে উন্নত ছাত্রজীবনের চারিত্রিক ইতিহাস মূল্যায়ন করা। ৬. সব অফিস-আদালতে নৈতিকতা ও সততার জন্য পদোন্নতি ও পুরস্কারের প্রথা চালু করা।
৭. আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। ৮. পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার ব্যবস্থা করা। ৯. বিশেষ ট্রাইবুনালে সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রকৃত দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করা। ১০. প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে দেশের সৎ মানুষদের দায়িত্ব দেয়া।
দেশে বহু আইন আছে; কিন্তু তার প্রয়োগের জন্য সর্বস্তরের আন্তরিকতা বিশেষভাবে দরকার। সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হবে নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষায় আলোকিত এক পরিচ্ছন্ন সমাজ ও দেশ।
লেখক: আবদুল হামিদ, এডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও সিএফও, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি.