পদমর্যাদায় খুশি নন অধিকাংশ শিক্ষক

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পদমর্যাদা নিয়ে খুশি নন অধিকাংশ শিক্ষক। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে (রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রম) অবস্থান নিয়ে খুশি নন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকরা। আর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের তো জায়গাই নেই। বছরের পর বছর ধরে তারা আলোচনা করছেন ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে জায়গা নেয়ার। 

বর্তমানে  'রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রম' বা 'ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স'-এ ১৬ নম্বরে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। সরকারের সচিবরাও এই ক্রমে রয়েছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা রয়েছেন এর পরের ধাপে, ১৭তম ক্রমে। জাতীয় অধ্যাপকরাও এই ধাপেই অবস্থান করছেন। আর সিলেকশন গ্রেডভুক্ত অধ্যাপকরা রয়েছেন ১৯তম ক্রমে।  

দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়,  শিক্ষকতায় সরকারি ও বেসরকারি দুটি ভাগ থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা কোনো পদমর্যাদাই পান না। তাদের ক্ষোভ আরও বেশি। একই চ্যান্সেলরের (রাষ্ট্রপতি) মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদমর্যাদা উচ্চে হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কোনও জায়গা নেই। 

জানা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে সব শিক্ষকদের পদমর্যাদার ক্রম ঠিক না থাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আয়োজকরাও বিব্রত হন। কার আগে কার নাম লিখবেন, কে কোন চেয়ারে বসবেন তা নিয়েও সমস্যা হয়। এ অবস্থায় শিক্ষকদের পদমর্যাদার জটিলতা নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ আশা করছেন শিক্ষকরা। 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক :কাঙ্ক্ষিত পদমর্যাদা পাচ্ছেন না উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেড বাতিলের কারণে শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের বেতন ও পদমর্যাদা কমে যায়। সে সময়ে তারা এ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন। সেসময়ে দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকের লেখা ‘আমলাদের পয়দা করলো কোন বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের লেখায় নড়চড়ে বসেন প্রশাসনের শীর্ষ আমলারা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের পদমর্যাদা নিয়ে বেশ টানাপড়েনেই রয়েছেন। দেশে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন চালু রয়েছে। এগুলোতে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক কর্মরত। এই শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের তাদের শ্রমের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, সিলেকশন গ্রেড' বাতিল হওয়ায় শিক্ষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ওই সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে (গ্রেড-১) তারা আর যেতে পারছিলেন না। তারা সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১-এর সুযোগ-সুবিধা, বেতনও পাচ্ছিলেন না। শিক্ষকরা প্রশ্ন তোলেন, সচিবরা নিজেদের সুবিধার জন্য যদি সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে শিক্ষকদের জন্য সিনিয়র অধ্যাপকের পদ নয় কেন? 

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল  বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারা সুন্দর সমাধান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে সিনিয়র কয়েকজন মন্ত্রীকে দিয়ে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি করে দিয়েছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, অধ্যাপকদের তিনটি পদমর্যাদা নির্ধারিত হবে। সহযোগী অধ্যাপক থেকে সরাসরি পদোন্নতি পেয়ে যারা অধ্যাপক হবেন, তারা জাতীয় বেতন স্কেলের তৃতীয় গ্রেডভুক্ত হবেন। এর চার বছরে আরও দুটি স্বীকৃত গবেষণাপত্র প্রকাশের পর তারা গ্রেড-২-এ যেতে পারবেন। এর কমপক্ষে দুই বছর পর সংশ্নিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেড-২-এ থাকা ২৫ শতাংশ অধ্যাপক গ্রেড-১ ভুক্ত হবেন। এটা শিক্ষকদের বড় অর্জন।

তিনি বলেন, জনপ্রশাসনে সিনিয়র সচিবের স্কেলে তারাও সিনিয়র অধ্যাপকের পদ চেয়েছিলেন। মন্ত্রিসভা কমিটি সে সময়ে কথা দিয়েছিল, এটা নিয়ে পরে আমাদের সঙ্গে তারা বসবেন। এ আলোচনা আর এগোয়নি। 

বাংলাদেশ অধ্যক্ষ সমিতির সভাপতি ও দৈনিক শিক্ষার উপদেষ্টা সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, শিক্ষকদের মর্যাদার জায়গাটি ঠিক করে দিতে হবে সরকারকেই। রাষ্ট্রীয় মর্যাদাক্রমে শিক্ষকদের আরও ওপরে জায়গা দিতে হবে।

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়াধীন সরকারি কলেজগুলোতে পাঠদানকারী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষকদেরও রয়েছে অসন্তোষ। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তাদের জায়গা না থাকায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা বিব্রত হন। তারাও এর অবসান চান। 

মাধ্যমিক শিক্ষক : প্রাথমিকের মতো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদায় ছিলেন।  ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে তাদের পদমর্যাদা বাড়ানোর ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

জানা গেছে, পদমর্যাদা উন্নীত হলেও মাধ্যমিক শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া অত্যন্ত মন্থর। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হতে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়; অনেকের চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যায়। এ বিষয়ে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক সাখায়েত হোসেন দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, তিনি আমাদের মর্যাদা দিয়েছেন। এখন পদোন্নতির নানা জটিলতাও দ্রুত কাটানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। 

প্রাথমিক শিক্ষক :২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করেন। একই দিনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সে হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাদের বেতন স্কেল নির্ধারণ হওয়ার কথা জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে। তবে তা না করে মন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল নির্ধারণ করেছে ১১তম গ্রেড (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) ও ১২তম গ্রেডে (প্রশিক্ষণবিহীন)। অথচ নন-ক্যাডার দ্বিতীয় শ্রেণির পদে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তারা জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডেই বেতন পান। পরে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার গেণ্ডারিয়ার মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি রিয়াজ পারভেজসহ ৪৫ জন উচ্চ আদালতে রিট করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে গত বছরের ৫ মার্চ রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। সেই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে আদালত প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেলের দশম গ্রেডসহ (প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণবিহীন) গেজেটেড পদমর্যাদা দিতে নির্দেশ দেন। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মার্চ থেকে এটি কার্যকর করতে আদেশ দেন আদালত। এরপর গত ৩১ জুলাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল দশম গ্রেডে উন্নীত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়।

প্রধান শিক্ষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত পদমর্যাদা ও বেতনক্রম পেলেও সহকারী শিক্ষকদের চাওয়া পূরণ হচ্ছে না। তারাও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে থাকতে চান না; চান দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা ও ১১তম গ্রেডে বেতন। এ বিষয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতা হাবিবুর রহমান  বলেন, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পান কিন্তু তাদের পদমর্যাদা দুই রকম।  এটা হয় না। প্রাথমিক শিক্ষকরা 'তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী', এটা বর্তমান সমাজের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তাদের দাবি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদমর্যাদা কমপক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হোক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.015533924102783