সরকারের উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতেই পদ্মা সেতু নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া পাঁচজনকে গ্রেফতার করে এমন তথ্য পেয়েছে র্যাব। তাদের সবাই জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী বলে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে মানুষের মাথা লাগবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুকে ব্যাপক গুজবকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে। আর এই মিথ্যা প্রচারণায় জড়িত পাঁচজনকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব সদর দপ্তরের পাশাপাশি এই মিথ্যা প্রচারণা প্রতিরোধে তৎপরতা শুরু করে পুলিশের সাইবার গোয়েন্দা বিভাগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মনে করছেন, স্বার্থবাদী অপপ্রচারকারী মহল সব সময়ই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। এ ধরনের গুজব মানুষ হত্যার হাতিয়ার। এই মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যাও করা হয়েছে। এর আগেও এ ধরনের অপপ্রচারে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই অপপ্রচার নিয়ে ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় মানবাধিকারকর্মী, মনোবিজ্ঞানীসহ অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পের সঙ্গে মানুষের ভাবমূর্তি জড়িত। একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই উন্নয়ন ব্যাহত করতে এ ধরনের গুজব রটিয়ে দেশবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। যারা এই অপপ্রচার চালিয়েছে, শুনেছি তাদের অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। তারা এই মিথ্যা অপপ্রচারে জড়িত থাকলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তারা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত হেনেছে। বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তাদের শাস্তি দিতে হবে এই কারণে যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক কাজ করতে না পারে।’
র্যাব জানায়, গ্রেফতার পাঁচজনকে আসামি করে সংশ্লিষ্ট থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে গত ১১ জুলাই ঢাকার উপকণ্ঠ আশুলিয়ার ইপিজেড এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া আকরাম হোসেন নিজেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী পরিচয় দিয়েছে। তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ও একটি কম্পিউটার জব্দ করে তাতে এই প্রচারণা চালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আকরাম পাবনার সাঁথিয়া থানার হাটবাড়িয়া এলাকার জামায়াতের রোকন শাহজাহান আলীর ছেলে। ফেসবুক ছাড়াও একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে সে পদ্মা সেতু নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালায়।
তাকে গ্রেফতারকারী র্যাব-১-এর এএসপি কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিভিন্ন ফেক নামে আকরামের সাতটি ফেসবুক আইডি আছে। সেগুলো থেকে সে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতো। দলীয় সিদ্ধান্তে সে পদ্মা সেতু তৈরি করতে মানুষের মাথা লাগবে বলে ফেসবুক, অনলাইনে গুজব ছড়ানোর কথা স্বীকার করেছে। তার ফেসবুক পেজ থেকে জানা গেছে, ময়মনসিংহে মাজার ধ্বংস করা হবে। ঠিক একইভাবে নড়াইল জেলার লোহাগড়া শহীদুল ইসলাম, মৌলভীবাজারের ফারুক, কুমিল্লার লাকসামের হায়াতুন নবী এবং চট্টগ্রামের আরমান হোসাইনও জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থক দাবি করেছে।
গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানায়, বর্তমান সরকারকে বিব্রত করতে আলাদা একাধিক ইউনিট গঠন করেছে জামায়াত-শিবির। সাইবার গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত শিবিরের চালানো গুজবকে কেন্দ্র করেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। মোহাম্মদপুরে এক নারীকে একই সন্দেহে বেদম মারধর করা হয়। পুলিশ দ্রুত গিয়ে তাকে উদ্ধার না করলে হয়তো তাকেও মরতে হতো। লক্ষ্মীপুর জেলার দালালবাজারে ছেলেধরা সন্দেহে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে পুলিশে দেয় লোকজন। ভাগ্যের সহায়তায় বেঁচে যায় সে। পুলিশ এসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, মিথ্যা প্রচারণা বা গুজবে বিশ্বাস করে মানুষ এ ধরনের কাজ করেছে।
মিথ্যা প্রচারণার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কাজের উদ্বোধন করার সময় চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় মূল সেতুর ওপর পরীক্ষামূলক ভিত্তি স্থাপনের সময় নদীতে গরু ও খাসির রক্ত ঢালার পাশাপাশি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া কয়েকটি মুরগির তথ্য প্রচার করা হয় ইন্টারনেটে। তখন গণমাধ্যমেও এই নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছিল। সেই সময়ের পশুর রক্তের ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল গ্রেফতারকৃতরা। তারা সেই ছবিকে মানুষের রক্তের ছবি বলে চালাতে থাকে। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ফের শুরু হয় এই মিথ্যা প্রচারণা।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণাকে ‘কুচক্রী মহলের গুজব’ বলে গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত মঙ্গলবার পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠান।