পরীক্ষা পদ্ধতি: ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কথায় বলে, ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখন সেই দশা: নতুন নতুন আবিষ্কারে মেতেছে। দুটি আবিষ্কার দেশে হইচই ফেলে দিয়েছে। গ্রেডিং পদ্ধতি সংস্কার করে সর্বোচ্চ সূচক ৫ থেকে ৪-এ নামিয়ে আনা; প্রতিটি স্লটে একটি করে মাইনাস জিপিএ এবং সর্বোচ্চ জিপিএ A+ প্লাসের ঘাড়ে একটি নতুন A-E (E হলো এক্সিলেন্ট) চালু করা। আরও একটা খবর বাতাসে ভাসছে অনেক দিন থেকে। পাসের জন্য সর্বনিম্ন নম্বর ৩৩ থেকে বাড়িয়ে ৪০ করা। এসব নাকি চালুর ঘোষণা আসবে সেশনের মধ্যভাগে। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেমন ব্যস্ত, তেমনি মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভের অন্ত নেই। বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন আমিরুল আলম খান।

একটু ফিরে দেখা যাক। ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাসের বিভাগ ছিল তিনটি—প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ। প্রতিটি বিষয়ে কমপক্ষে শতকরা ৩৩ নম্বর পেলে পাস বা তৃতীয় বিভাগ, সব বিষয়ে পাস করে মোট ৪৫ শতাংশ নম্বরে দ্বিতীয় বিভাগ, আর সব বিষয়ে পাস করে মোট নম্বর ৬০ শতাংশ হলে প্রথম বিভাগ দেওয়া হতো। কোনো বিষয়ে ৮০ শতাংশ নম্বর পেলে সে বিষয়ে ‘লেটার’, সব বিষয়ে পাস করে মোট ৭৫ শতাংশ নম্বর পেলে দেওয়া হতো ‘স্টার’। এ ছাড়া ছিল সম্মিলিত মেধাতালিকা আর মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের জন্য আলাদা মেধাতালিকা। নারীশিক্ষা উৎসাহিত করতে মেয়েদেরও আলাদা মেধাতালিকা করা হতো। সে অনুযায়ী দেওয়া হতো বৃত্তি। 

সে পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফল প্রকাশের সময় দেশের ‘সেরা মেধাবীদের’ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেত। পাশাপাশি সমালোচনাও হতো। বলা হতো, এ পদ্ধতি শিশুদের ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় নামিয়েছে। কাজেই সে ইঁদুর দৌড় থেকে শিশুদের রক্ষা করতে ২০০১ সালে আমদানি করা হলো গ্রেডিং পদ্ধতি। অন্তত তখন এ কথাই জোর গলায় প্রচার করা হয়। 

গ্রেডিং পদ্ধতিতে কাউকে দেশের ‘সেরা মেধাবী’ ঘোষণা করা হবে না, ঘোষণা করা হবে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু তাতেও যখন আবার নতুন করে ইঁদুর দৌড় শুরু হলো, তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘোষণা করা নিষিদ্ধ করে।

গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর সময় সর্বোচ্চ স্কেল করা হয় ৫। আর জিপিএ করা হয় ছয় স্তরের। ফেল করলে এফ গ্রেড। পাস করলে এ+, এ, বি, সি এবং ডি। পাসের জন্য প্রতি বিষয়ে ৩৩ নম্বর। এরপর ৪০ < ৫০ ডি, ৫০ < ৬০ সি, ৬০ < ৭০ বি, ৭০ < ৮০ এ এবং ৮০-১০০ পেলে এ প্লাস। বছর 

পাঁচেক পর বি জিপিএ ভেঙে জুড়ে দেওয়া হয় এ মাইনাস (৬৫ < ৭০)। তাতে বি, মানে খাটো হলো ৬০ < ৬৫ নম্বরে। এভাবে জিপিএ সাত ভাগ হলো। কিন্তু এটা কেন করা হয়েছিল, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা জাতি কোনো দিন জানতে পারেনি।

এত দিন পর মন্ত্রণালয় আবিষ্কার করেছে, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই জিপিএর সর্বোচ্চ স্কেল ৫ নেই; আছে ৪। জগৎজুড়ে নাকি তেমনই বিধান। তাই একটা বিহিত করা এখনই দরকার। সারা দেশে এখন জবর খবর, ২০১৯ সালের জেএসসি পরীক্ষা থেকেই পাবলিক পরীক্ষায় ৫-এর মাপ খাটো করে ৪ করা হবে। 

সর্বোচ্চ সূচক ৫ থেকে ৪-এ নামিয়ে এনে যে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে, তা কি বিষয়টিকে সহজ করবে, নাকি আরও জটিল করবে? কেননা, বাংলাদেশে জিপিএ সর্বোচ্চ সূচক সর্বত্র ৪ হলেও জিপিএ ক্যালকুলেশনে সব গ্রেড ইন্টারভ্যাল সমান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া হয় সিজিপিএ। স্নাতক স্তরে সেমিস্টার পদ্ধতিতে চার-পাঁচ বছরে অর্জিত জিপিএ সমন্বয় করে সিজিপিএ নির্ধারণ করা হয়। বোর্ডের পরীক্ষায় তার দরকারই নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের প্রশ্ন অবান্তর। 

এতে বেশ কিছু ঝামেলা হবে। প্রথমত, বিগত বছর পর্যন্ত উত্তীর্ণদের সঙ্গে এবারের নতুন পদ্ধতিতে যারা উত্তীর্ণ হবে, তাদের ফলে সামঞ্জস্য বিধান করতে লেগে যাবে কয়েক বছর। এমনকি, অন্তত আগামী চার বছর পুরোনো পদ্ধতিতে পরীক্ষায় যারা অংশ নেবে, তাদের বকেয়া টানতে হবে শিক্ষা বোর্ডগুলোকে। ভর্তি করার সময় ঝামেলা বাড়বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। চাকরিদাতাদের এ আপদ বইতে হবে অন্তত এক যুগ। কেন? সর্বোচ্চ সূচক ৪ স্কেলে এবার যেসব পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হবে, তারা কিন্তু গতবারের সূচক ৫-এর সমমানের। কিন্তু গতবারের ৪ পাওয়া পরীক্ষার্থীর সর্বোচ্চ প্রাপ্ত নম্বর ৭০ হলেও এবারের পরীক্ষার্থীদের জন্য তা হবে ৮০ < ৯০ নম্বর। ফলে এবার যারা ৮০ < ৯০ নম্বর পাবে, তারা গতবার পর্যন্ত যারা ৭০ < ৮০ পেয়েছে, তাদের কাতারে নেমে আসবে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিন্তু এখানেই ক্ষান্ত নয়। তারা জিপিএ (গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ) নতুন ছাঁচে সাজাতে চায়। চালু ৭ গ্রেড ভেঙে করতে চায় ১৩ গ্রেড। তারা গ্রেড ফারাক (ইন্টারভ্যাল) কমিয়ে আনতে চায়। অর্থাৎ ডি গ্রেড থেকে এই পর্যন্ত প্রতিটি গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজের মধ্যে ১০ মার্কের ফারাক কমিয়ে ৫ করা হবে। তাতে প্রতিটি স্লটে একটা করে (-) মাইনাস যুক্ত হবে। যেমন নতুন নিয়মে যোগ হবে ই মাইনাস, ডি মাইনাস, সি মাইনাস, বি মাইনাস। (আগে থেকেই একটা এ মাইনাস ছিল। তাই এ মাইনাস দরকার হচ্ছে না)। তবে এ প্লাসের মাথায় বসবে একটা সুপার গ্রেড—এই। তারা যুক্তি খাড়া করেছে, কোনো বিষয়ে পরীক্ষার্থী ৮০ পেলেও এ+ (প্লাস), আবার ১০০ পেলেও এ‍+ প্লাস। এতে সুবিচারের ঘাটতি দেখছে তারা। আরও মেধাবীদের স্বীকৃতি জুটছে না। (তাই অতি মেধাবীদের অভিজাত বানানোর তরিকায় এ প্লাসের ওপরে বসানো হবে সুপার গ্রেড A-E। এখানে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হবে। এর ফলে আমাদের শিশুদের নতুন করে আবার ইঁদুর দৌড়ে শামিল করা হবে, যার পরিণতি হবে ভয়াবহ । 

লেখক : যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029208660125732