পরীক্ষার ফলাফল কেন শিশুদের আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর জিপিএ ফাইভ না পেয়ে অথবা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে সম্প্রতি অন্তত তিনজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শাহনাজ পারভীন। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়,  বরিশালে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাননি সেটা জানার পরই মঙ্গলবার বাড়িতে এসে গলায় ফাঁস দিয়ে নিজের প্রাণ নিয়েছেন ১৪-বছর বয়সী এক কিশোরী।

তার পরিবারের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যবসায়ী যাদব দাস বলছেন, "আমার বন্ধু খুব ভেঙে পরেছে। আল্লাহ একটাই সন্তান দিয়েছিলো তাকে। তাও বিয়ের দশ বছর পর। সুন্দরভাবে তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু দু:খজনক ব্যাপার গতকাল পরীক্ষায় রেজাল্ট শুনে স্কুলে কে তাকে কী বলেছে, কোন বান্ধবীরা কী বলেছে, সেটা শুনে সে সুইসাইড করেছে।"

শরিয়তপুরের গোসাইঘাটে জেএসসি পরীক্ষায় পাস করতে না পেরে এক কিশোরী এবং নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে পরের ক্লাসে উঠতে না পেরে একই পথ বেছে নিয়েছেন এক কিশোর। পুলিশের বরাত দিয়ে এমনটাই জানা গেছে। প্রতি বছরই বড় কোন পরীক্ষার ফল প্রকাশের এমন খবর যায়।

পরীক্ষার ফল শিশুদের কেন এই পথে ঠেলে দিচ্ছে

ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা বেশি আবেগপ্রবণ থাকে।

অল্পতেই খুশি, দু:খ ও রাগ বোধ করা কিশোর বয়সের বৈশিষ্ট্য। পরীক্ষায় ব্যর্থতার পর পরিবারের সহযোগিতার অভাব, বরং উল্টো তাকে কটু কথা শোনানো, প্রতিবেশী, আত্মীয় ও সহপাঠীদের চাপও বড় কারণ। তিনি বলছেন, "এই যে বাচ্চাগুলো যখন পরীক্ষা ফেল করছে বা রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে, বাবা-মা প্রচণ্ড বকাঝকা করছে।

তিনি বলছেন, "অনেক সময় একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেই বাচ্চারা সেটা শোনে বা কাগজে দেখে। তারা সেটা দেখে মোটিভেটেড হয়ে যায়। তারা ভাবে আমার মতো একজন যদি এটা করতে পারে তাহলে আমিও করতে পারি।"

অনেক সময় তারা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যা বা তোর মতো সন্তান থাকার থেকে না থাকা ভালো ছিল। তারা এমনিতেই আবেগপ্রবণ। এই জিনিসগুলো তাদের আরও অনেক আবেগপ্রবণ করে ফেলে।"

তিনি আরও বলছেন, "অনেক সময় রেগে গিয়ে বাবা-মাকে ভয় দেখানোর জন্য তারা এটা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু যেহেতু তাদের বয়স কম। তাদের জানার ঘাটতি আছে যে কতটুকু করলে তারা বিপদে পরবে না। অনেক সময় যেটা হয় আত্মহত্যা করতে না চাইলেও, ঘটনাটা ঘটে যায়।"

পরীক্ষা পদ্ধতি কতটা দায়ী?
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেন ১০ থেকে বড়জোর ১৫ বছর বয়সীরা। সমাপনী পরীক্ষা দুটি হয় জাতীয় পর্যায়ে যাতে সারা দেশের এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। বিভিন্ন গ্রেড দিয়ে মেধা যাচাই হয় যার মধ্যে সর্বোচ্চ হচ্ছে জিপিএ-ফাইভ।

শিশুদের এক ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়। ফেনির সোনাগাজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিটুবি রানি গুহ বলছেন, "ছোট বয়সে তারা খেলাধুলা করবে।

তাদের ভেতরে এই বয়সে খেলাধুলার আগ্রহটাই বেশি থাকে। একসাথে এত বড় একটি পরীক্ষায় অংশ নেয়া এবং তাতে ভাল ফল করার বিষয়টি এই বয়সে অনেক বড় মানসিক চাপ।"

তিনি মনে করেন, অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষার এই ফল গরীব পরিবারের অনেককে চাকরি পেতে সহায়তা করে তবে পঞ্চম শ্রেণির এমন সমাপনী পরীক্ষার কোন প্রয়োজন নেই। এমন পরীক্ষা পদ্ধতি কতটা দরকার সে নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন অনেক দিনের।

শিক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা এডুকো'র বিশেষজ্ঞ গোলাম কিবরিয়া বলছেন, "শিক্ষাটা এমন হওয়া উচিত যেখানে একটা জিনিস জানবে, চর্চা করবে, বন্ধুদের সাথে শিক্ষকদের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করবে এবং সত্যিকার অর্থে কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করবে।

"বরং কোচিং করে, গাইড বই পরে, প্রাইভেট পরে, মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে কত নম্বর পাওয়া যাবে সেজন্য সারা বছর কিছু শিশু শুধু পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়। নম্বর পাওয়ার এই পরীক্ষা কোন পদ্ধতি হতে পারে না।"

তিনি আরও বলেন, ভাল ফল করার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাপও কাজ করে। আর সেটি ঘটে সরকারি সহায়তা পাওয়ার জন্য। তার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, "স্কুল যেগুলো সেগুলো বেশিরভাগই এমপিও ভিত্তিক। ভালো বা খারাপ রেজাল্ট এমপিও ভুক্তির একটি বড় মাপকাঠি।"

সরকার কী পরিকল্পনা করছে?
বাংলাদেশের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছিলেন গ্রেডিং পদ্ধতির মাধ্যমে মেধা যাচাই সবচাইতে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

কী কারণে এমন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিলো তার ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, "সব দেশে এই বয়সী শিশুদের একটা অ্যসেসমন্ট হয় যে তারা কতটা স্কিলস্‌ অর্জন করলো। দুটো পরীক্ষার মাধ্যমে সেটা করা হচ্ছে। সেই কথা চিন্তা করে এই পদ্ধতি চালু করা হয়। কিন্তু আমরা এই পদ্ধতিকে কম্পিটিটিভ করে তুলেছি। গ্রেডিং পদ্ধতির একটা সাইড এফেক্ট হলও বাবা মায়েরা ছেলে-মেয়ের উপর ভালো ফলের জন্য চাপ দেয়। "

তিনি বলছেন, এখন গ্রেডিং পদ্ধতিতে পরিবর্তন সহ এখন এই পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করা হচ্ছে।

শুধু মুখস্থ বিদ্যা নয়, শিশুরা জীবনে আগে বাড়ার জন্য কতটুকু সঠিক দক্ষতা অর্জন করেছে সেটির যাচাই সারাবছর ধরেই করার কথা বলছেন তিনি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037341117858887